সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের অভিযোগে র্যাবের হাতে আটক ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব বড় হয়েছেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায়। সেখানে দুই টাকার বিনিময়ে দোকানে দোকানে পানি সরবরাহ আর পুরোনো কাঠ-বাঁশ বিক্রি করে অনেক কষ্টে সংসারের খরচ যোগাতেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে এসে পাল্টে যান তিনি।
আর কাউন্সিলর হওয়ার পর রাতারাতি মালিক হয়ে যান বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ির। এমনকি নিজের নিরাপত্তার জন্য রাখেন সশস্ত্র বডিগার্ড। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, জমি দখল, একচ্ছত্র ক্ষমতা গ্রাসসহ নানা অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
শনিবার রাতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব আটক হন। এরপর তাকে সঙ্গে নিয়ে তার বাসা ও অফিসে রাতভর অভিযান চালায় র্যাব। এখন তিনি র্যাব-১ এর প্রধান কার্যালয়ে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি মামলা করার কথা জানিয়েছে র্যাব।
এদিকে রাজীবের গ্রেপ্তারের খবরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে মোহাম্মদপুর এলাকায়। চায়ের দোকান, খাবার হোটেল, বাসস্ট্যান্ডসহ সব জায়গায় এখন আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু রাজীব। বয়স্ককে আলোচনায় ওঠে আসছে রাজীবের ছেলেবেলা, বেড়ে ওঠা এবং রাজনীতিতে সরব হওয়ার নানা গল্প।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, রাজীবের শৈশব কেটেছে মোহাম্মদিয়া হাউজিং এলাকায়। সেখানে রুবেল, আনিসসহ বেশ কয়েকজন বন্ধু ছিল তার। তারা সংঘবদ্ধভাবে নির্মাণাধীন ভবন থেকে রড চুরি করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজীবের বাবা তোতা মিয়া ভবন নির্মাণ ঠিকাদার। নির্মাণকাজের পর বেঁচে যাওয়া কাঠ-বাঁশ কেজি দরে বিক্রি করতেন রাজীব।
২০০১ সালের পরবর্তী সময়ে রাজীবের বেড়ে ওঠা শিয়া মসজিদ বাজারে। এলাকার পুরনো এই বাজারে পাঁচ লিটারের বোতলে করে দোকানে দোকানে পানি সরবরাহ করতেন রাজীব। বিনিময়ে পেতেন দুই টাকা করে। তখন কর্মচারী সাদেক ছিলেন তার সহযোগী। সেই সাদেক এখন তার ব্যক্তিগত সহকারী।
২০০২-২০০৩ সালের মধ্যে ওই সাদেকের হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন রাজীব। কিছুদিন রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থেকে বনে যান মোহাম্মদিয়া হাউজিং যুবলীগ ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক। বছর ঘুরতেই এই পদে জায়গা পান ওয়ার্ড কমিটিতে।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হলে তার মুক্তির দাবির আন্দোলনে সরব ছিলেন রাজীব। পরে তিনি মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক হন।
এলাকাবাসী জানান, অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছেন রাজীব। রাজীবের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে এলাকার কারো মুখে কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি। বরং তার গ্রেপ্তারের বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না অনেকেই।শান্ত স্বভাবের রাজীব অল্প সময়ে রাজনীতির মাঠের মূল শক্তি জনবল জোগাড় করে ফেলেন। আর এটাই এনে দেয় তাকে রাতারাতি সফলতা।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সেই সময়ের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানকের দৃষ্টিতে আসেন রাজীব। ২০০৯ সালে নানক ঢাকা-১৩ আসনের সংসদ সদস্য হলে রাজীবের অবস্থান হয়ে ওঠে আরও সুদৃঢ়। নামের সাথে যুক্ত হয় ‘লায়ন’। এসময় স্থানীয়রা তাকে চিনতেন ‘লায়ন টিজেড রাজীব’ নামে।
২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেয়া হয় ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের (উত্তর) সিনিয়র সহসভাপতি শেখ বজলুর রহমানকে। মনোনয়ন না পেয়ে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন রাজীব। সেই নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। আর কাউন্সিলর হওয়ার পরই পাল্টে যায় তার জীবনচিত্র। রাতারাতি তিনি বনে যান কোটি কোটি টাকার মালিক।