দেশে চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে ৩৩২ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে৷ আর গত বছর হত্যা করা হয়েছে ৫২১ শিশুকে৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব বলছে শিশু হত্যা ক্রমাগত বাড়ছে৷
আসকের হিসাব অনুযায়ী, এই বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর এই নয় মাসে শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৩১২টি আর গত বছরের ১২ মাসে এই সহিংসতার সংখ্যা ছিল এক হাজার ১১টি৷ জরিপে দেখা যায়, পাঁচ থেকে ১২ বছরের শিশুরাই সবচেয়ে বেশি হত্যা ও সহিংসতার শিকার৷ বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটছে পরিবার ও পরিচিত পরিবেশের মধ্যে৷
হত্যা ছাড়াও শিশুরা ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি, অ্যাসিড সন্ত্রাস ও অপহরনের শিকার হয়৷ এমনকি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেও৷ স্কুলে শিক্ষকের হাতে শিশু নির্যাতনের সংখ্যাও কম নয়৷ ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয় শিশু গৃহকর্মীরাও৷
এদিকে এসব হত্যা ও নির্যাতরে ঘটনায় মামলা হয় অর্ধেকেরও কম৷ আসক বলছে, চলতি বছরে এপর্যন্ত ৩৩২টি শিশু হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ১৫১টি৷
সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে বাবা ও চাচার হাতে শিশু তুহিন হত্যার ঘটনা আরও একবার সমাজকে নাড়া দিয়েছে৷ কিন্তু এটাই প্রথম নয়৷ তুহিন হত্যার কয়েক দিন আগে সাভারেও একইভাবে শিশু হত্যার অভিযোগ পাওয়া যায়৷
শিশু অধিকার ফোরামের সাবেক সভাপতি ও শিশু অধিকার কর্মী ইমরানুল হক চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘নিজ পরিবারের মধ্যে বা পরিচিত পরিবেশে শিশু হত্যার এই ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন করে৷ এখন প্রশ্ন উঠেছে আমাদের পারিবারিক বন্ধন ও মূল্যবোধ নিয়ে৷ এখানে নিশ্চয়ই গভীর কোনো সংকটের সৃষ্টি হয়েছে৷ প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে বাবা-চাচা সন্তানকে হত্যা করবে এটা কোনো সামাজিক অবস্থায়ই মেনে নেয়া যায় না৷ আমাদের নতুন করে চিন্তা করা দরকার পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে শিশুর প্রতি সহিংসতা বাড়ছেই৷ আর শিশু যেহেতু প্রতিবাদ করতে পারে না, সে যেহেতু প্রতিরোধ করতে পারে না, তাই প্রতিহিংসাসহ নানা বিকৃত আচরণের শিকার হয় শিশু৷ আমাদের সমাজটি শিশুবান্ধব নয়৷ এটা আমাদের সমাজের বড় একটি নেতিবাচক দিক৷ শিশু এখন পারিবারিক ও সামাজিক রাজনীতি এবং দ্বন্দ্বের শিকার হচ্ছে।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘শিশু তুহিন হত্যার ঘটনা আসলে ব্যাখ্যা করা কঠিন৷ কারণ সাধারণভাবে বলা হচ্ছে জমিজমা নিয়ে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে৷ তাই বলে নিজের সন্তানকে হত্যা! সেতো শত্রুকেও হত্যা করতে পারত৷ আসলে আমার মনে হয়েছে যে স্বার্থের কাছে সে এতই অন্ধ হয়েছে যে, তার মনুষ্যত্বই লোপ পেয়েছে৷ এটা আমার কাছে নতুন একটা পরিস্থিতি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সমাজেই শিশুর প্রতি সহিংসতার উপাদান আছে৷ শিশুকে গুরুত্ব এবং সম্মানের জায়গায় রাখা হয় না৷ আর শিশু যেহেতু দুর্বল তাই তার ওপরই আঘাত আসে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে দেশে যথেষ্ট আইন আছে৷ কিন্তু আইন থাকলেই হয় না৷ আইনকেতো শুধু কিছু লিখিত বিষয় হিসেবে বিবেচনা করলে চলবে না৷ এর একটা দার্শনিক দিক আছে৷ আমার বিবেচনায় সমাজে মূল্যবোধ ও মানবিকতার চরম অবক্ষয়ের প্রকাশ এই শিশু হত্যা৷ শিশুর প্রতি সহিংসতা মানে দুর্বলের প্রতি সহিংসতা৷ এটা বিবেচনা করলেই অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘আইনমন্ত্রীই বলছেন এখন বিভিন্ন মামলায় শাস্তির হার মাত্র তিন ভাগ৷ ৯৭ অপরাধীর বিচার হয় না৷ আগে আমাদের ধারণা ছিল ১৫-২০ ভাগ বিচার হয়৷ এই পরিসংখ্যান দিয়ে বিচারহীনতার পপুলার কথা বলা যাবে৷ কিন্তু অপরাধ দমনে বিচার হওয়াই যথেষ্ট নয়৷ সমাজ যদি অপরাধপ্রবণ হয় তাহলে সেটা বড় ধরনের সংকট৷ আমরা সেই সংকেটর মধ্য দিয়ে যাচ্ছি৷ ঘুষ, দুর্নীতি, হত্যাসহ আরো অনেক অপরাধের পুঞ্জিভূত প্রকাশই হচ্ছে এই শিশু হত্যা৷ এটা জঘন্য একটা অমানবিক স্বার্থপর সমাজের লক্ষণ৷’ –ডয়চে ভেলে