দেশজনতা অনলাইন : দেশের মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা আর মানসিক অস্থিরতা বেড়েছে। বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন দেশের অনেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। পারিবারিক-সামাজিক-রাজনীতিক নানা কারণে হতাশাও বেড়েছে। আর হতাশাজনিত নানা কারণে আত্মহননের মতো ঘৃণিত কাজও অনেকে করে বসেন। তবে ইতিবাচক দিক হলো আগের চেয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা কমেছে।
এমন পরিস্থিতিতে আজ বিশ্বে পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’। দিবসটিতে এবারের প্রতিপাদ্য ‘মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও আত্মহত্যা প্রতিরোধ’। ১৯৯২ সালে প্রথমবার পালন করা হয়েছিল এ দিবস। কিছু কিছু দেশে একে মানসিক রোগ সচেতনতা সপ্তাহের অংশ হিসাবেও পালন করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতি ছয় মিনিটে নয়জন মানুষ আত্মহত্যায় মারা যায়। তবে ইতিবাচক বিষয় হলো এই গত বছরের তুলনায় চলতি বছর ৯ দশমিক ৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ডব্লিউএইচও’র মতে, বিভিন্ন কারণে মানুষ আত্মহত্যা করেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্যক্তিত্বজনিত সমস্যা, গুরুতর মানসিক রোগ, মাদকাসক্তি, অস্থিরতা, হতাশা কিংবা প্ররোচণা।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ছাড়াও আত্মহত্যা ও আত্মহত্যার প্রবণতার সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সমস্যাও অনেকাংশে দায়ী। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা, অপ্রাপ্তি, অসহ্য মানসিক চাপ, মানসিক ও যৌন হয়রানি, সহিংসতা, যৌতুকের চাপ, পরকীয়া, প্রেমের সম্পর্কে জটিলতা, দাম্পত্যকলহ প্রভৃতি থেকে সাময়িক নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
বিষয়টির সঙ্গে মানসিক চাপ মোকাবেলার দক্ষতার অভাব ও ব্যক্তিত্বের ভঙ্গুরতা সম্পর্কযুক্ত। তার ওপর যখন শেষ আশ্রয়স্থল ঘনিষ্ঠজন ও পরিবারের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হন, তখন ওই ব্যক্তি আত্মহত্যা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না। এজন্য মানসিক চাপ মোকাবেলার দক্ষতা ও ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা অর্জন আত্মহত্যা প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা রাখে।
দাম্পত্য কলহের জেরে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন আছমা খানম (ছদ্দনাম)। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে তিনি ঘুমের ওষুধ খান। পরিবারের সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করায় তিনি বেঁচে যান।
ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হতো। সংসারে আমার কথার মূল্যায়ন হয় না। এত কষ্ট করি তারপরও খারাপ ব্যবহারের শিকার হই। কয়েকদিন আগে অকারণেই খুব খারাপ ব্যবহার করেছেন আমার স্বামী। তাই ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছি।
আছমা বেঁচে গেলেও আত্মহত্যার কারণে প্রতিবছর অনেক মানুষই নানান জটিলতায় পড়ে আত্মহত্যা করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক ড. তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়েসাস বলেন, ‘প্রতিটি মৃত্যু পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং সহকর্মীদের জন্য হৃদয়বিদারক। তবে আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য। আমরা সব দেশকে টেকসই উপায়ে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে বিষণ্নতার হার ৪ দশমিক ৬। জরিপে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের মধ্যে মানসিক রোগ দ্বিগুণ এবং বিষণ্নতার হার আগের তুলনায় তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, ‘আমাদের দেশে স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে শরীরকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটা তেমন লক্ষ্য রাখা হয় না। নারী-পুরুষ সবার ক্ষেত্রেই এটা দেখা যায়। আর নারীরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এখনও পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে। পুরুষ সিদ্ধান্ত দেয় আর নারীরা মেনে নেয়। ফলে দেখা যায় নারীরা ছাড় দিতে দিতে ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হতে থাকে। আর এখান থেকেই মানসিক অশান্তি শুরু হয়।’
‘এটা থেকে উত্তরণ পেতে নারীর শারীরিক মানসিক দুই দিকেই আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে তার মানসিক অবস্থাকে গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবারে তার যথার্থ মূল্যায়ন হলে অনেক সমস্যাও কমে আসবে।’
কিশোর-কিশোরীদের আত্মহত্যার প্রবণতা
এদিকে ‘বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্স’ সম্প্রতি আরেকটি জরিপে দেখা গেছে, দেশে বছরে গড়ে ১০ হাজার নর-নারী আত্মহত্যা করেন। প্রতি ১ লাখে ৭ দশমিক ৩ জন আত্মহত্যা করেন। গ্রামে আত্মহত্যার হার শহরের চেয়ে ১৭ গুণ বেশি। আত্মহত্যাকারীদের বড় অংশই অশিক্ষিত ও দরিদ্র। আর শহর-গ্রামে নারীদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। এদের মধ্যে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যা করে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গবেষণায় বলা হয়, দেশে গড়ে প্রতিদিন ২৮ জন আত্মহত্যা করে। তারা ফাঁস লাগিয়ে এবং বিষ খেয়ে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে, ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে, গাড়ির নিচে কিংবা চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়েও আত্মহত্যা করেন। এ ছাড়া উপেক্ষা, অবহেলা, কটূক্তি, অপরাধপ্রবণতা, পারিবারিক সহিংসতা এবং যৌন নিপীড়নের কারণে আত্মহত্যার দিকে তাড়িত করে কিশোর-কিশোরীদের। তাদের কেউ কেউ পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না পেয়েও আত্মহননের দিকে যায়।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘পরিবার অনেক সময় সন্তানদের নিয়ে অতিরিক্ত আকাঙক্ষা পোষণ করে। অনেক মা-বাবা চাপ দেয় সন্তানকে জিপিএ ফাইভ পেতেই হবে।’
‘কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সন্তানদের প্রতি বাবা-মার সাপোর্টিং কেয়ার নিতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে যেকোনো একটি বিষয়ে ব্যর্থতা থাকা মানেই জীবন শেষ নয়। আব্রাহাম লিংকন, ডারউইন, আইনস্টাইনদের মত বড় বড় ব্যক্তিরা কিন্তু শিক্ষাজীবনে সফল ছিলেন তা কিন্তু নয়। এই বিষয়টি শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে। তাদের ভেতর বাস্তবতা মেনে নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি করতে হবে।’
তাজুল বলেন, ‘দেখা যায় কোনো ব্যাপারে সন্তান খারাপ রেজাল্ট করলো, তখন কিন্তু এমনিতেই তার মন ভালো থাকে না। তার ওপর পরিবার থেকে যদি বলা হয় তোমার জন্য এত টাকা খরচ করলাম আর তুমি এ কি করলে! তাহলে সে হতাশ হবে।’
‘পরিবার থেকে সন্তানদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিতে শেখাতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে জীবন আনেক বড়। আত্মহত্যা কোনো সমাধান হতে পারে না।’