সীমান্ত থেকে ট্রাকবোঝাই পেঁয়াজ ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। কর্মকর্তারা পেঁয়াজ চোরাচালান বন্ধ করতে অভিযান চালানোর হুমকি দিচ্ছেন। টন টন পেঁয়াজের ওপর নির্ভরশীল প্রতিবেশীদের কাছে খবর যাচ্ছে : একটা পেঁয়াজও ভারত ছাড়তে পারবে না।
প্রথমে খরা ও পরে মওসুমি বৃষ্টিপাতের ফলে পেঁয়াজের স্বল্পতার সৃষ্টি হয়ে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দাম তিনগুণ হয়েছে, কোনো কোনো দেশে তুলকালাম ঘটার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার রান্নায় পেঁয়াজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এমনকি বৈদেশিক নীতি ও অভ্যন্তরীণ সম্প্রীতি রক্ষাতেও এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
নয়া দিল্লির গবেষক চারু সিং বলেন, পেঁয়াজ ছাড়া খাবার হয় অসম্পূর্ণ, বর্ণহীন।
বেকারত্ব বাড়া, ভারতের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘনীভূত হওয়ার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চলতি সপ্তাহে পেঁয়াজ স্বল্পতা কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার প্রশাসন কেবল পেঁয়াজ রফতানিই বন্ধ করেনি, পাইকারি ও খুচরা মজুতের সীমাও নির্ধারণ করে দিয়েছে।
এই পদক্ষেপে প্রমাণ করছে, মোদি শেষ পর্যন্ত কোথায় সবচেয়ে নাজুক। তা হলো অর্থনীতি।
দেশের বাইরে তিনি কাশ্মিরের স্বায়াত্তশাসন বাতিল, সৈন্য পাঠানো ও বহির্বিশ্ব থেকে উপত্যকাটিকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য সমালোচিত হচ্ছেন।
তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার উত্তর-পূর্ব ভারতে আগ্রাসী প্রচারণায় লাখ লাখ লোককে, তাদের অনেকে মুসলিম, নাগরিকত্ব বাতিল করার হুমকি দিচ্ছে।
তবে ভারতের অনেকের কাছে পেঁয়াজের মূল্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উদ্বেগজনক অর্থনৈতিক আলামত হিসেবেই পেঁয়াজ সমস্যাটি সামনে এসেছে। গাড়ি প্রস্তুতকারী, বেকারি এবং এমনকি আন্ডারওয়্যার শিল্পও কঠিন সময় অতিবাহিত করছে। দীর্ঘ সময়ের মধ্যেও ভালো কিছু দেখা না যাওয়ায় হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।
মোদির কঠোর পেঁয়াজনীতির ফলে পণ্যটির দাম সহনীয় হয়ে আসছে। তবে চাষিদের সাথে দীর্ঘ দিনের বিরোধ অবসান ঘটছে না। তারা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকে, নগরের ভোক্তাদের খুশি রাখতে তাদেরকে একেবারে কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়।
আবার এতে পররাষ্ট্রনীতিরও সম্পৃক্ততা রয়েছে। ভারতের প্রতিবেশীরা কষ্টে আছে, তারা ক্রুদ্ধ হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় পেঁয়াজের দাম কয়েক মাসের মধ্যে ৭০০ গুণ বেড়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
ফুটপাতের এক দোকানদার বলেন, দাম শুনে লোকজন তাকে ‘ডাকাত’ বলে গালি দেয়।
তিনি এই গালি সহ্য করতে না পেরে পেঁয়াজ বিক্রিই বন্ধ করে দিয়েছেন। আরো অনেকেই এই কাজ করেছেন। ফলে ঢাকার রাজপথ থেকে পেঁয়াজ উধাও হয়ে গেছে।
পেঁয়াজ আসলে এমন কিছু পণ্য, যার কোনো বিকল্প নেই। প্রায় প্রতিটি তরকারিতে এটি দিতেই হয়।
এক রেস্তোরাঁ ম্যানেজার মোহাম্মদ বিলাস বলেন, বাজারে পেঁয়াজ এখন স্বর্ণের মতো।
তিনি বলেন, তিনি এখন পেঁয়াজ ব্যবহার অনেক কমিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বিরানির মতো রান্নায় পেঁয়াজ লাগবেই।
নেপালের লোকজন দীর্ঘ দিন ধরে পেঁয়াজ সঙ্কটে রয়েছে। গত বছর তারা ভারত থেকে ৩৭০ মিলিয়ন পাউন্ড পেঁয়াজ আমদানি করেছে। এবার পণ্যটি আসছে না।
মঙ্গলবার নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর কালিমাতি বাজারের মুখপাত্র বিজয়া শ্রেষ্ঠা বলেন, আমরা কারখানায় পেঁয়াজ তৈরী করতে পারি না। আমাদের কাছে যে বিকল্প আছে তা হলো পেঁয়াজ কম খাওয়া।
অনেকে চীন থেকে পেঁয়াজ আমদানির কথা ভাবছেন। তবে চীনা পেঁয়াজ বড় ও স্বাদহীন। লোকজন তা পছন্দ করে না।
ভারত বিপুল পরিমাণে পেঁয়াজ রফতানি করে। ভারত সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশটি গত অর্থবছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন পাউন্ড পেঁয়াজ রফতানি করেছে।
সরকার পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণা করার মাত্র দু’দিনের মধ্যে ভারতে পণ্যটির দাম বেশ করেছে। কয়েক মাস আগে এক কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ২৫ রুপি, তা গত সপ্তাহে হয় ৭০ রুপি। এখন হয়েছে ৫০ রুপি। এতে নগর ভোক্তাদের স্বস্তি দিয়েছে।
তবে দাম কমতে থাকায় ভারতীয় কৃষকেরা আবার চাপে পড়ে গেছে। তারা বলছে, তারা ন্যায্য দাম পাচ্ছে না। তাদের মতে, ফায়দা লুটছে মধ্য সত্ত্বাভোগীরা।
পণ্য মূল্য কম রাখার সরকারি নীতির বিরুদ্ধে কৃষকেরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে অনেক দিন ধরেই। এ কারণে চলতি বছর সরকার নির্বাচনী প্রচারণায় কৃষকদের সহায়তার প্রতিশ্রুত দিয়েছিল। কিন্তু মোদি সরকার দাম কম রাখার ওপরই জোর দিচ্ছে প্রবলভাবে।
প্রতিবাদে মধ্য ভারতের পেঁয়াজ উৎপাদনকারী অঞ্চলের কৃষকেরা নিলাম বন্ধ পর্যন্ত করে দিয়েছিল। অনেকেই মনে করছে, মোদি তার প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গেছেন।
মোদির অর্থনৈতিক দল আগের সরকারগুলোর চেয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, গত ছয় মাসে ভোক্তা মূল্য দ্রুততার সাথে বাড়ছে।
এদিকে হিন্দুদের একটি বড় উৎসব সামনে চলে আসায় মোদি প্রশাসন পণ্য মূল্যের দিকে কড়া নজর রাখছে।
বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করছেন, এ নিয়ে সরকার বেশ চাপে আছে।
প্রখ্যাত কৃষি অর্থনীতিবিদ অশোক গুলাতি বলেন, এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত। আপনি পেঁয়াজ ভোগকারী বৃহত্তর ভোট ব্যাংকের জন্য কৃষকদের নিয়ে গঠিত অপেক্ষাকৃত ছোট ভোট ব্যাংককে বলি দিচ্ছেন