খুলনা নগর ও জেলার একাধিক কিশোর অপরাধী গ্রুপকে নজরদারিতে রেখেছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী।
হত্যা, ধর্ষণ, মাদক সেবন ও ব্যবসা এবং যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে এসব কিশোর অপরাধীরা। এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনায় কিশোর অপরাধীদের সম্পৃক্ততার প্রমাণও মিলেছে। এমনকি গণধর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে ‘বন্ধু’ নামের একটি গ্রুপের বিরুদ্ধে। আদালতে অপরাধের দায় স্বীকার করে জবানবন্দিও দিয়েছে গ্রেপ্তার হওয়া একাধিক কিশোর।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, খুলনা জেলার বিভিন্ন স্থানে আটটি কিশোর গ্রুপের সন্ধান মিলেছে। প্রতিটি গ্রুপেই ৮/১০ জন সদস্য রয়েছে। এসব গ্রুপের অবস্থান বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বাইপাস সড়কের পাশ্ববর্তী এলাকায়। ইভটিজিং, মাদক সেবনসহ বিভিন্ন অপকর্মে এসব গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
নগরীর খালিশপুর পৌরসভা, পার্কের মোড়, হাউজিং বাজার ও আলমনগরে একটি, খানজাহান আলী (র.) সেতু ও পুরাতন রূপসা এলাকায় একটি, সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড-খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে নতুন রাস্তার মোড়ে একটি, জিরোপয়েন্ট থেকে আফিল গেট বাইপাস সড়কে একটি, বয়রা-পাবলিক কলেজ মোড়-মুজগুন্নি এলাকায় একটি, দিঘলিয়া উপজেলার তেতুলতলা মোড়ে একটি, বটিয়াঘাটা উপজেলা সদরে একটি এবং ফুলতলায় উপজেলা সদরে একটি গ্রুপ রয়েছে। প্রত্যেকটি গ্রুপে ৮/১০ জন বা এর বেশিও সদস্য রয়েছে। এরা লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সময় অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নগরীর জিরোপয়েন্ট থেকে আফিল গেটে বাইপাস সড়কের গ্রুপটি ছিনতাই, চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রম করে। বয়রা কলেজ মোড় ও মুজগুন্নি এলাকার গ্রুপটির সদস্যরা স্কুল, কলেজে না গিয়ে বিভিন্ন স্থানে মাদক সেবন করে। দিঘলিয়ার গ্রুপটি স্কুল ছুটির পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যেই বিভিন্ন অপরাধ কার্যক্রম করে থাকে। বটিয়াঘাটার গ্রুপটি ও যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের মত কাজের সাথে সম্পৃক্ত।
র্যাবের তথ্য মতে, রূপসা এলাকা, সোনাডাঙ্গা থেকে নতুন রাস্তা এবং ফুলতলা এলাকায় তিনটি গ্রুপ রয়েছে।
সূত্র জানান, গত বছরের ২০ জানুয়ারি খুলনা পাবলিক কলেজে কনসার্ট চলাকালে সমবয়সী বন্ধুদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ফাহমিদ তানভির রাজিন নিহত হয়। রাজিন হত্যার পর গ্রেপ্তার হয় সাব্বির (১৬), রিফাত, মিতুল, ফাহিম, রয়েল, আপন (১৪), রিজভী (১৩), আলিফ (১৬) ও জিসান খান (১৩)। এদের মধ্যে রিফাত ও রিজভি ‘ডেঞ্জার বয়েজ’ গ্রুপের সদস্য। আর সাব্বির ‘গোল্ডেন বয়েজ’ গ্রুপের। ফাহিম ইসলাম মনিও (১৩) ‘গোল্ডেন বয়েজ’ গ্রুপের সদস্য। হত্যাকাণ্ডের পর র্যাবের হাতে আটক হয়ে রয়েল ও মিতুল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানায়। এর মধ্যে কয়েকজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। ওই ঘটনার তদন্তে ১৫ থেকে ২০ জন কিশোর অপরাধীর নাম জানতে পারে পুলিশ।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, কিশোরদের মধ্যে একটু সিনিয়রদের গ্রুপটি ‘ডেঞ্জার বয়েজ’ নামে পরিচিত। মাদক বিক্রি ও সেবনসহ ছিঁচকে অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিশোর গ্রুপ ‘টিপসি বয়েজ’ নামে পরিচিত। এ গ্রুপের সদস্যরা বেশির ভাগই বস্তি এলাকার। আর স্কুল পড়ুয়াদের আরেকটা গ্রুপের নাম ‘গোল্ডেন বয়েজ’। ডেঞ্জার বয়েজ ও গোল্ডেন বয়েজ গ্রুপটি পরিচালিত হয় মহানগরীর বৈকালী বাজার এলাকা থেকে। আর টিপসি গ্রুপটি পরিচালিত হয় মহানগরীর বয়রা পালপাড়া এলাকা থেকে। ছোট ছোট অপরাধ থেকে শুরু করে কিশোরদের এই গ্রুপগুলো এখন খুন ও ধর্ষণের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছে।
এর আগে গত ৩০ জুন নগরীর পশ্চিম বানিয়াখামার বিহারী কলোনী এলাকার একটি বাসায় নিয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণ করে সাত কিশোর। ওই ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার প্রধান আসামি শান্ত বিশ্বাসসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃত অন্যরা হলো মঈন হোসেন হৃদয় (২০), নুরুন্নবী আহম্মেদ (২০), শেখ শাহাদত হোসেন (২০), মো. রাব্বি হাসান ওরফে পরশ, মো. মাহামুদ হাসান ওরফে আকাশ ও মো. সৌরভ সেখ। এদের মধ্যে চারজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
তার আগে ২৮ জানুয়ারি খুলনা মহানগরীর আফিলগেট কলোনির এক এসএসসি পরীক্ষার্থীকে একটি পরিত্যক্ত ভবনের ছাদে নিয়ে গণধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় ওই ছাত্রীর বাবা বাদী হয়ে তিনজনের বিরুদ্ধে খানজাহান আলী থানায় মামলা করেন। পয়লা ফেব্রুয়ারি খানজাহান আলী থানা পুলিশ রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে ধর্ষক খানজাহান আলী থানার আটরা এলাকার আমজাদ শিকদারের ছেলে মো. সাগর আলী, মসিয়ালী এলাকার রেণু মিয়ার ছেলে মো. বিল্লাল ও একই এলাকার টোকন আলীর ছেলে শফিকুর রহমান শফিককে গ্রেপ্তার করে। অভিযুক্তরা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ধর্ষণের কথা স্বীকারও করে।
এর আগে গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে রূপসা হাইস্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী খলিলুর রহমান সিয়ামকে (১৫) খুন করা হয়। হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্তরা স্থানীয় একটি ছোট গ্রুপের সদস্য। এ মামলার আসামিদের মধ্যে খ্রিস্টানপাড়ার গোলদারের ছেলে রনি ওরফে বড় রনিকে পুলিশ ২৪ জানুয়ারি রাতে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করে। এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন টুটপাড়া দারোগাপাড়া এলাকার বাবুর বাড়ির ভাড়াটিয়া মো. ইউসুফ খানের ছেলে রায়হান খান (১৭), টুটপাড়া খ্রিস্টানপাড়ার বাবুলের ছেলে নয়ন (১৬), চাঁনমারী মেসের সড়কের মহারাজের ছেলে রাসেল (১৮), সামাদ গ্রেডারের বাড়ির ভাড়াটিয়া মো. হানিফের ছেলে রাব্বি (১৮), টুটপাড়া মেইন রোড হাবিবা মঞ্জিলের বাসিন্দা আলাউদ্দিন মৃধার ছেলে মো. আবু সাইদ ওরফে ছোট (১৬), টুটপাড়া লতা স্টোর গলির বাসিন্দা মো. শহিদুল ইসলামের ছেলে আলামিন হোসেন রনি ওরফে ছোট রনি (১৮), দারোগাপাড়া এলাকার প্রত্যুষ (১৮) ও দারোগাপাড়ার হাসিবের বাড়ির ভাড়াটিয়া ওসমান (১৭)।
এদিকে, সর্বশেষ ২১ সেপ্টেম্বর পুলিশ নগরীর সদর থানার জাহিদুর রহমান সড়ক এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা, গাজা ও মাদক বিক্রির ৩৮ হাজার টাকা উদ্ধার এবং কিশোরসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে।
এ বিষয়ে নগর গোয়েন্দা শাখার উপ-পুলিশ কমিশনার বিএম নুরুজ্জামান বলেন, মহানগরে কোন নামধারী গ্যাং রয়েছে বলে কোনো তথ্য নেই। তবে একাধিক ‘গ্রুপ’ বা ‘বন্ধু মহল’ রয়েছে। তাদের কার্যক্রম আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। কেউ কোন কিছু করলেই সাথে সাথে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারব।
জেলা গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আনিসুর রহমান জানান, ইভটিজিং, মাদকসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতার জন্য নয় উপজেলায় কার্যক্রম চলছে। যদি কোন গ্রুপের সন্ধান থাকে তবে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
র্যাব-৬ খুলনার অধিনায়ক লে. কর্নেল সৈয়দ মোহাম্মদ নূরুস সালেহীন ইউসুফ বলেন, বৈখালী এলাকা কেন্দ্রীক আগের তিনটি কিশোর গ্যাং নিস্ক্রিয় হয়ে গেছে। তবে, বর্তমানে নতুন করে তিনটি গ্রুপ সক্রিয় হয়েছে। যা আমাদের নজরদারিতে রয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন বাজার ও বাইপাস সড়কের আশেপাশের গ্রুপগুলোর দিকে আমরা নজরদারি করছি।