সম্প্রতি রোহিঙ্গা ডাকাত নূর মোহাম্মদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পর বেরিয়ে আসে রোহিঙ্গাদের হাতে এনআইডির স্মার্ট কার্ড যাওয়ার বিষয়টি। এই স্মার্ট কার্ডের তথ্য অনুযায়ী তার নাম নূর আলম, বাবার নাম কালা মিয়া। এরপরই অনুসন্ধানে নামে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ পুলিশ। সন্ধান মেলে আরও অনেক রোহিঙ্গার নামে এনআইডি থাকার বিষয়টি।
অনুসন্ধানে ধরা পড়ে চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশন (ইসি) কার্যালয়ের ল্যাপটপ গায়েবের ঘটনাও। এ ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় ইসির অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদিনসহ তিনজনকে। মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় চট্টগ্রামের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটকে।
এরই মধ্যে পুলিশের বিশেষায়িত এই ইউনিট এজাহারভুক্ত আসামিদের বাইরেও মোস্তফা ফারুক নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। মোস্তফা ফারুক ইসিতে আউটসোর্সিং কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতো। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে দুটি ল্যাপটপ। এর একটি ইসির।
চট্টগ্রাম সিটিটিসির উপ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘তদন্তে পাওয়া প্রত্যেকটি জিনিসই আমরা যাচাই করবো। যাদের নাম আসবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। মামলার তদন্ত চলছে। তাই এ মুহূর্তে বেশি কিছু বলবো না।’
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার ঘটনায় যারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করতে কাজ করছি। মামলার এজাহারে ৫ জনের নাম দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা এর বাইরেও একজনকে এরই মধ্যে গ্রেফতার করেছি। আরও কিছু নাম সন্দেহের তালিকায় আছে। তাদেরও আটকের চেষ্টা চলছে।’ সবগুলো বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত কাজ চালানো হচ্ছে মন্তব্য করেন তিনি।
পুলিশের দায় সম্পর্কে জানতে চাইলে শহীদুল্লাহ বলেন, ‘কোনও কিছু যদি ভুয়া হয়, সেক্ষেত্রে কেউ দায় এড়াতে পারে না। প্রত্যেকের ঘাড়েই কিছু না কিছু দায় এসেই যায়।’
গত ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী তিন রোহিঙ্গা তরুণকে চট্টগ্রামের আকবর শাহ এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা দালালের মাধ্যমে নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে পাসপোর্ট করেছে বলে পুলিশকে জানায়। নোয়াখালীতে কর্মরত পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (ডিএসবি) দুই সদস্য তাদের কাগজপত্র ভেরিফিকেশন করে অনাপত্তিপত্রও দেয়। এ অবস্থায় পুলিশ ভেরিফিকেশন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরে তদন্ত কমিটি করা হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নোয়াখালীর পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন বলেন, ‘তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। রোহিঙ্গা তরুণদের পাসপোর্ট নেওয়ার বিষয়ে যে দুই পুলিশ সদস্য প্রতিবেদন দিয়েছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।’
তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন বলেন, ‘এটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তাছাড়া দায় তো অনেকেরই থাকতে পারে। যেমন ইউনিয়ন পরিষদ ও এনআইডিসহ অনেকগুলো ডিপার্টমেন্ট এর সঙ্গে জড়িত।’
অন্যগুলোর কথা তারা বলতে পারবেন না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘পুলিশ সদস্যরা কতটুকু দায়িত্ব পালন করেছে, সেই বিষয়ে শুধু আমি ব্যবস্থা নিতে পারবো।’
রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনে গাফিলতিসহ আর্থিক সুবিধা নেওয়ার বিষয়ে তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের সমন্বিত কার্যালয় চট্টগ্রাম-২-এর উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে ১৫০টি পাসপোর্টের আবেদনপত্র আমাদের হাতে এসেছে। এই সংখ্যাটা আরও বাড়বে। এর মধ্যে ৩৫ জন রোহিঙ্গা পাসপোর্ট নিয়েছে। এই ৩৫টি পাসপোর্টে যে পুলিশ সদস্যরা ভেরিফিকেশন করে ক্লিয়ারেন্স দিয়েছেন, তাদের আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসবো।’
দুদকের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবান এলাকার মেয়র, কাউন্সিলর ও চেয়ারম্যানসহ যেসব জনপ্রতিনিধি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সনদ দিয়েছেন তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করবো।’
এজন্য ঢাকায় দুদকের সদর দফতরে অনুমতি চাওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক জনপ্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের কেউ বলেছেন, তারা দেননি। আবার কেউ বলেছেন, তারা না জেনে দিয়েছেন। সেজন্য সেসব জনপ্রতিনিধিকেও আইনের আওতায় নিয়ে আসবো।’
শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘এনআইডি, ইউনিয়ন পরিষদ ও সিটি করপোরেশন অফিস, নির্বাচন কমিশন ও পাসপোর্ট অফিসের যত সিন্ডিকেট আছে আমরা সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসবো।’
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক মো. আবু সাইদ বলেন, পাসপোর্ট করার যেসব শর্ত রয়েছে, সেগুলো যদি কেউ পূরণ করে তখন তাদের ধরার সুযোগ থাকে না। পাসপোর্টের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহের সময় সতর্ক হলে রোহিঙ্গারা আর পাসপোর্ট করতে পারবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।