২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ২:১২

ঢাকার ক্যাসিনো চালাতে চীন ও নেপাল থেকে আনা হয় দক্ষ লোক

দেশজনতা অনলাইন : ঢাকায় যতগুলো আধুনিক বৈদ্যুতিক ক্যাসিনো জুয়ার বোর্ড আছে, সেগুলো অপারেট করতে চীন ও নেপাল থেকে অভিজ্ঞ লোক আনা হয়েছে। তারাই এই বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করে। বিনিময়ে প্রতি মাসে বেতন পায় তারা। বুধবারের অভিযানের পর এরকম কয়েকজন নাগরিকের পাসপোর্ট ও নাম ঠিকানা পাওয়া গেছে। তাদের কাছে ওয়ার্ক পারমিট আছে কিনা তা খতিয়ে দেখছে র‌্যাব।

বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) বিকাল থেকে মধ্যরাত পযন্ত ঢাকার বনানী, মতিঝিল, ফকিরাপুল ও গুলিস্তানের ক্যাসিনোতে অভিযান অভিযান পরিচালনা করে র‌্যাব-৩ ও ১। ক্রীড়া সংগঠনের নামের আড়ালে এসব ক্যাসিনোর ভেতরের রঙিন আলো ও আধুনিক সাজসজ্জা দেখলে যেকারও চোখ ঝলসে যাবে। এসি রুমের এসব ক্যাসিনোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমনভাবে করা, যাতে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতেই ভয় পায়।

র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, ‘আমরা ক্যাসিনোতে চীন ও নেপালি নাগরিকদের পেয়েছি। এখানে তারা চাকরি করেন বলে জানিয়েছে। তবে সত্যি তাদের ওয়ার্ক পারমিট আছে কিনা, তা আমরা খতিয়ে দেখছি।’

এর আগে, বুধবার বিকাল ৩টার দিকে প্রথমেই মতিঝিল থানার পেছনে ফকিরাপুল এলাকার ইয়ংমেন্স ক্লাবে অভিযান চালায় র‌্যাব। সেসময় কয়েকজন চীনা ও নেপালি নাগরিককে সেখানে পাওয়া যায়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে তাদের তথ্য রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে নেপালের দুজনার নাম হলো- ভূপেস ও সঞ্জয়। তারা ক্যাসিনোতে কাজ করেন।

অভিযানে র‌্যাবের হাতে মেঘা ও লিজা নামের দুই তরুণী আটক হলেও তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ক্যাসিনোতে তারা ‘ডিলার’ পদে চাকরি করেন বলে জনিয়েছেন। লিজা  বলেন, ‘ক্যাসিনোতে দুই সিফটে জুয়া খেলা হয়। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা এবং রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা। জুয়ার বোর্ডগুলো চীনা নাগরিকরা চালু করে। নেপালিরা বোর্ড পরিচালনা করে। তারা এগুলো অপারেট করতে দক্ষ।’

লিজা আরও বলেন, ‘আমরা মাসিক ও দিন হিসেবে এখানে চাকরি করি। আমরা কখনও রিসিপশনে, কখনও বোর্ডে দায়িত্ব পালন করি।’

মেঘা বলেন, ‘প্রতি শিফটে ৭০-৮০ জন মানুষ খেলে। কখনও বেশিও আসে। তবে রাতের বেলায় বেশি মানুষ থাকে।’ সেখানে অনেকে মাদক সেবন করে বলেও তারা জানিয়েছে।

ইয়ংমেন্স ক্লাবে কী পাওয়া গেলো?

এই ক্লাবটি গত দুই বছর হলো খোলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তবে অনেকের দাবি, ক্লাবটি আরও আগে হয়েছে। এটি আগে ফকিরাপুল ক্লাব নামে পরিচিত ছিল। জুয়ার আসর বসানোর পর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।

সবচেয়ে বেশি আটকের ঘটনা এই ক্লাবেই। ২৮/কে, টয়েনবি সার্কুলার রোডের পুরাতন এই বাড়িটির নিচতলার প্রবেশের মুখেই মেটাল ডিটেক্টর ও সিসি ক্যামেরা। সেখানে প্রবেশ করলেই পা পড়বে বড় হলরুমে। যার ভেতরে রঙিন আলো, বড় বড় ফ্ল্যাস গেম জুয়ার মেশিন ছয়টি। এরপর ক্যাসিনো বোর্ড সাতটি। বোর্ডের ওপরে ক্যাসিনোর কয়েন, তাস, সিগারেট পড়ে আছে। কক্ষের বাম পাশে ক্যাশ রুম। সেখানে রয়েছে লোহার সিন্দুক, টাকা গোণার মেশিন, টাকা বান্ডিল করার রাবার এবং বিলাসবহুল চেয়ার ও কম্পিউটার। এই ক্যাসিনোতে রয়েছে একটি রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টের পাশ দিয়ে হেঁটে সামনে গেলে মিলবে ভিআইপি ক্যাসিনো কক্ষ।

সুসজ্জিত দুটি ভিআইপি কক্ষের সিকিউরিটিও আলাদা। সেখানে রয়েছে মদ, সিগারেট, বসার সোফা, ফোমের চেয়ার, দামি ঝাড়বাতি।

এই ক্যাসিনোতে অভিযান চালিয়ে ১৪২ জনকে সাজা দিয়েছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। উদ্ধার করা হয়েছে ২৪ লাখ টাকা ও মদ বিয়ারসহ বিভিন্ন মাদক। অভিযান শেষে ক্যাসিনোটি সিলগালা করে দিয়েছে র‌্যাব।

র‌্যাব জানিয়েছে, এই ক্যাসিনো পরিচালনা করেন গ্রেফতার হওয়া  যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এরপর তাকে তার গুলিস্তানের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাবে হতো সব ধরনের জুয়া

ইয়ংমেন্স ক্লাবের পাশেই রয়েছে ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাব। ক্লাবটি পুরনো। ইয়ংমেন্স ক্লাবের চেয়ে চাকচিক্য কম। ক্লাবের নিজস্ব কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। ভেতরে ক্যাসিনো, গুটির জুয়া, শিলং তীর জুয়া এবং লটারিসহ বিভিন্ন জুয়া খেলার সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। বিশাল জায়গার এই ক্লাবটির ভেতরে রান্নাবান্নাও হয়। র‌্যাবের অভিযানে সেখানে পাওয়া গেছে ১০ লাখ ২৭ হাজার ২০০ টাকা, ২০ হাজার ৫০০ জাল টাকা। এছাড়াও মদ, বিয়ার এবং যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট।

র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফিউল্লাহ বুলবুল  বলেন, ‘এখান থেকে কাউকে আটক করা যায়নি। তারা বিকালে পালিয়েছে।’

এই ক্লাবের পাশেই কয়েকজন যুবলীগ নেতার কক্ষ রয়েছে। ক্লাবটি বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার আলহাজ মোমিমুল হক সাঈদ নিয়ন্ত্রণ করছেন। তার সঙ্গে রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের মোল্লা আবু কাওসার। র‌্যাব এছাড়াও আরও কয়েকজন যুবলীগ নেতার নাম বলেছে যারা দক্ষিণ যুবলীগ সভাপতি ইসমাঈল চৌধুরী সম্রাটের ঘনিষ্ঠ।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রে শুধুই ক্যাসিনো

যে আদর্শিক জায়গা থেকে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র গঠিত হয়েছে সেই আদর্শের ছিটাফোটাও নেই। উল্টো ক্যাসিনো ও মাদকের আখড়ার ক্লাবে পরিণত হয়েছে এটি। ক্যাসিনোর ক্লাবে টাঙানো হয়েছে দেশের বর্ণাঢ্য মানুষের ছবি। এই ক্লাবটি থেকে ৪০ জনকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৯ জন স্টাফ। সবাইকে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম।

ক্লাবটি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে নগদ ৩ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। মদ, বিয়ার ও হিরোইনের মতো দেখতে পাউডার, কষ্টি পাথর।

এই ক্লাবের ভেতরে সাতটি জুয়ার বোর্ড পাওয়া গেছে। এরমধ্যে দুইটি কক্ষে রয়েছে ভিআইপিদের জন্য আলাদা দুটি বোর্ড।

গুলিস্তানের এই ক্লাবটির প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই নামাজের ঘর। তারপর ক্যাসিনোর কক্ষ। ক্যাসিনোর কক্ষের পর রয়েছে যুবলীগ নেতার ইসমাঈল হোসেন সম্রাটের কক্ষ। সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার ছবি টাঙানো রয়েছে। ছোট ছোট কক্ষের ভেতরে বিছানা পাতানো দেখা গেছে। সিন্দুকের লকার ভেঙে র‌্যাব উদ্ধার করেছে নগদ টাকা।

রাত সাড়ে ১২টার দিকে অভিযান শেষ করে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, ‘ক্রীড়া সংগঠনের আড়ালে এসব ক্লাবে গড়ে তোলা হয়েছে ক্যাসিনো এবং মাদকের আখড়া। এই সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি জারি করেছে। মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে। এসব ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িতে হোক, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।’

প্রকাশ :সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৯ ১২:৫৯ অপরাহ্ণ