দেশজনতা অনলাইন : রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের সম্পূর্ণ গ্রামে সব বসতি গুড়িয়ে দিয়েছে মিয়ানমার সরকার।
সেখানে তৈরি করা হচ্ছে পুলিশের ব্যারাক, সরকারি ভবন ও শরণার্থী পুনর্বাসন শিবির। সম্প্রতি সেখানে পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকরা এমনটিই দেখতে পেয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
মিয়ানমার সরকারের উদ্যোগে আয়োজিত এক সফরে গিয়ে বিবিসি অন্তত চারটি স্থানের সন্ধান পেয়েছে যেখানে সুরক্ষিত স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। অথচ স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে সেখানে আগে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বসতি ছিল।
তবে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা গ্রামে এসব স্থাপনা তৈরির অভিযোগ নাকচ করেছেন মিয়ানমারের কর্মকর্তারা।
রাখাইনে ২০১৭ সালে মিয়ানমার বাহিনীর অভিযানের ফলে সেখান থেকে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়।
জাতিসংঘ একে জাতিগত নির্মূল কর্মকাণ্ডের ‘বাস্তব’ উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। তবে মিয়ানমার সরকার জাতিগত দমন এবং গণহত্যার অভিযোগ ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করে আসছে।
তবে আগে অস্বীকার করলেও এখন তারা কিছু শরণার্থী ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে। কিন্তু গত মাসে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের দ্বিতীয় চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। মিয়ানমারের অনুমোদিত ৩ হাজার ৪৫০ রোহিঙ্গার মধ্যে কেউই ফেরত যেতে না চাইলে সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, ২০১৭ সালে সংঘটিত হত্যা-নির্যাতনের কোন জবাবদিহিতা নেই। তারা সেখানে স্বাধীনভাবে চলাফেরা এবং নাগরিকত্ব পিরে পাবে কি না তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এদিকে প্রত্যাবাসনে ব্যর্থতার জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করেছে মিয়ানমার। তারা বলছে, অনেক রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে তারা প্রস্তুত ছিলো। আর এই বিষয়টি প্রমাণ করতে বিবিসিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের তাদের প্রস্তুতি পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানায়।
সাংবাদিকদের এ দলে ছিলেন বিবিসির জনাথন হেড। তিনি জানান, সাংবাদিকরা সরকারি গাড়িতে সেখানে ভ্রমণ করেন। সাধারণত রাখাইনে প্রবেশের ক্ষেত্রে ব্যাপক কড়াকড়ি রয়েছে। পুলিশের তত্ত্বাবধান ব্যতীত ছবি তোলা ও সাক্ষাৎকার নেয়ার অনুমতি ছিল না তাদের। তারপরও সেখানে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদের জলজ্যান্ত প্রমাণ দেখতে পেয়েছেন তারা।
স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউট জানায়, ২০১৭ সালে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা গ্রামগুলোর মধ্যে কমপক্ষে ৪০ ভাগ গ্রাম পুরোপুরি গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
মিয়ানমার সরকারের প্রতিনিধি সাংবাদিকদের হ্লা পো কং নামের একটি ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সরকার দাবি করে যে, স্থায়ী আবাসে ফেরার আগে ওই শিবিরে দুই মাস ধরে থাকতে পারবে ২৫ হাজার শরণার্থী।
এক বছর আগে তৈরি করা হয়েছিল এই শিবির। তবে এখনো এর অবস্থা করুণ। এরইমধ্যে টয়লেটগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। ২০১৭ সালের সহিংসতায় ধ্বংস হওয়া দুটি গ্রাম ‘হ রি তু লার’ এবং ‘থার হায় কোন’ নামে রোহিঙ্গা গ্রামে এই শিবির তৈরি করা হয়েছে। তবে এটি করা হয়েছে দুটি রোহিঙ্গা গ্রাম গুড়িয়ে দিয়ে।
কিয়েন চং নামে আরেকটি পুনর্বাসন শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয় সাংবাদিকদের। সেখানে জাপান এবং ভারত সরকারের সহায়তায় বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য।
তবে এই পুনর্বাসন শিবির তৈরি করতে মিয়ার জিন নামে একটি রোহিঙ্গা গ্রাম বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয়। এই গ্রামটি নতুন করে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষা পুলিশ বাহিনীর জন্য বানানো একটি ব্যারাকের পাশে।
২০১৭ সালে এখানে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছিল রোহিঙ্গারা। ক্যামেরার পেছনে ওই গ্রাম গুড়িয়ে দেয়ার কথা স্বীকার করেন কর্মকর্তারা ।
সাংবাদিক জনাথন হেড আরো জানান, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে, আরেকটি সরকারি গাড়ি বহরে করে ভ্রমণের সময় ওই গ্রামের ছবি তুলেছিলেন তিনি। ওই গ্রামের অনেক বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো, কিন্তু বড় দালানগুলো অক্ষত ছিল। আর যে গাছগুলো রোহিঙ্গা গ্রাম বেষ্টন করেছিলো সেগুলোও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলো।
কিন্তু এখন, মিও থু গাই গ্রামেরর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বড় বড় সরকারি স্থাপনা আর পুলিশ কমপ্লেক্স ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনি। এমনকি সেই গাছগুলোও নেই।
জনাথন জানান, তাদের ইন দিন নামে আরেকটি গ্রামেও নিয়ে যাওয়া হয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ১০ জন বন্দি মুসলিম পুরুষকে হত্যাকাণ্ডের জন্য আলোচিত এই গ্রাম। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অল্প যে কয়টি নির্যাতনের ঘটনা স্বীকার করে এটি তার একটি।
ইন দিন গ্রামের তিন-চতুর্থাংশ বাসিন্দাই ছিলো মুসলিম, বাকিরা রাখাইন বৌদ্ধ। এখন, মুসলিমদের কোন চিহ্ন নেই। রাখাইনরা চুপচাপ এবং শান্তিপূর্ণ।
কিন্তু যেখানে রোহিঙ্গারা থাকতো সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো গাছপালা নেই। তার পরিবর্তে রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া আর সীমান্ত রক্ষী পুলিশের বিশাল ব্যারাক।
জনাথন আরো বলেন, ইয়াঙ্গনে ফেরার পথে বাস্তুচ্যূত এক তরুণ রোহিঙ্গার সাথে দেখা হয় তার। সাত বছর ধরে একটি আইডিপি ক্যাম্পে নিজের পরিবারের সাথে আটকা পড়েছে ওই তরুণ। ২০১২ সালে সিত্তে এলাকায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর এক লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গার সাথে ঘর ছাড়া হয় সে। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ নেই তার। এমনকি অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ারও সুযোগ নেই।
বাংলাদেশে থাকা শরণার্থীদের উদ্দেশ্যে সে বলে, ঝুঁকি নিয়ে তারা যাতে বাংলাদেশে ফিরে না আসে। তাহলে তার মতো তারাও এ ধরণের ক্যাম্পে আটকে পড়বে।
এদিকে রাখাইনে সরেজমিনে যে চিত্র পাওয়া যায় সে সম্পর্কে বক্তব্য জানতে মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্রের সাথে যোগাযোগ করা হলেও কোন মন্তব্য করেনি সরকার।