লাইফস্টাইল: অফিসের সব কর্মী সমান দক্ষতাসম্পন্ন নাও হতে পারে। যদি কোনো কর্মী লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারে কিংবা বাজে কাজ হস্তান্তর করে, তাহলে এ সম্পর্কে কোনো কিছু না বলা প্রশয় হতে পারে। আপনি হয়তো এই প্রত্যাশায় চুপ থাকছেন যে, ওই কর্মী নিজ থেকেই বিষয়টি একসময় কাটিয়ে উঠবে। কিন্তু চুপ থাকাটা শুধু আপনার না, প্রতিষ্ঠানেরও জন্যও অপকার হতে পারে।
যে কর্মী লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে তাকে সেটা জানানো উচিত, যাতে সে পরিস্থিতি খুব ভয়ানক পর্যায়ে যাওয়ার আগেই সংশোধন করার সুযোগটা পায়। কাউকে আগেভাগে সতর্ক করে দেয়ার চেয়ে ছাটাই করে দেয়া বেশি অস্বস্তিকর।
কার্যকরভাবে বিষয়টি বলা একটি সুক্ষ্ম শিল্প। ‘ওয়ার্কিং উইথ ডিফারেন্ট পিপল’ বইয়ের লেখক, কুপার স্ট্রাটেজিক গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা, শিল্প-সাংগঠনিক মনোবিজ্ঞানী অ্যামি কুপার হাকিম বলেন, ‘এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, উক্ত ব্যক্তিটিকে বিষয়টি জানানোর সঙ্গে তার আবেগ ও অনুভূতিগুলো সংযুক্ত থাকে।’
মোটামুটি নির্দেশিকা হচ্ছে, আসল মন্ত্রটা অনুসরণ করা। তা হলো: ‘এমন ভাবে কথা বলুন, আপনি কর্মীর স্থানে থাকলে কথাগুলো যেভাবে প্রত্যাশা করতেন।’ কথোপকথনটি যতক্ষণ কম বক্তৃতাভিত্তিক এবং বেশি সহযোগিতাভিত্তিক হয়, ততক্ষণ সেখান থেকে অনেকগুলো ইতিবাচক বিষয় রয়েছে যা বের হয়ে আসতে পারে।- বলেন ‘কাল্টিভেটিং এ ক্রিয়েটিভ কালচার’ বইয়ের লেখক ও প্রযুক্তি কোম্পানি বিএসউইফ্টের নির্বাহী জাস্টিন ডায়ার।
একটি প্রশংসার মাধ্যমে শুরু করুন
প্রথমেই যদি সমালোচনা করেন তাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এমন হতে পারে যে, এরপর আপনার মুখ থেকে যাই বের হোক না কেন সবই উক্ত ব্যক্তির কাছে কম গ্রহণযোগ্য হবে। তাই হাকিম প্রশংসার মাধ্যমে কথোপকথন শুরুর পরামর্শ দিয়েছেন।
হাকিমের মতে, ‘স্যান্ডউইচ’ পদ্ধতি ব্যবহার করে কথোপকথন শুরু করা উচিত। প্রথমে পজেটিভ কথা বলা, এরপর মাঝখানে নেগেটিভ সমালোচনা করা আবার সবশেষে পজেটিভ কিছু কথা বলে কথা শেষ করা উচিত।
হাকিম আরো উপদেশ দিয়েছেন, কথা শুরুর প্রশংসা বাক্যটি যেন মূল আলোচ্য বিষয় কেন্দ্রিক হয়। কর্মীকে তার সেই কর্মদক্ষতার কথাটি মনে করিয়ে দেয়া যা দেখে আপনি তাকে কাজে নিয়েছিলেন। যেমন আপনি বলতে পারেন, ‘আমি তোমাকে কাজে নিয়েছিলাম তোমার এই গুণাবলি বা অভিজ্ঞতা দেখে- আমি জানি যা আমার দলের জন্য একটি জয়।’
এরপর তাকে খারাপ সংবাদটি দিয়ে আঘাত করুন। তখন আপনি বলতে পারেন, ‘যাহোক আমি লক্ষ্য করেছি তুমি বারবার লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হচ্ছো, সময়সীমার মধ্যে কাজ জমা দিতে পারছো না। আমি মনে করি তুমি এটা করতে পারো এবং এখানে সফল হতে পারো। আমি এখানে তোমাকে সমর্থন জানানোর জন্য আছি।’
খোলাখুলিভাবে কর্মীকে তার কাজের জন্য ছাটাইয়ের হুমকি না দিয়ে আপনি যৌক্তিক সমালোচনাটাকে অনুপ্রেরণামূলকভাবে উপস্থাপন করতে পারেন।
সুনির্দিষ্ট হোন
আপনার ও কর্মীর মধ্যকার এই কথোপকথনের অন্যতম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত- চেষ্টারত কর্মীকে জানানো এবং বুঝানো যে কিভাবে এবং কেন সে লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। হাকিম বলেন, ‘কোম্পানির ম্যানেজার বা মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রতিনিধিদের সরাসরি ও পরিস্কার ভাষায় কর্মীদের সঙ্গে কথা বলাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
পাশাপাশি সমস্যার শক্ত উদাহরণ উপস্থাপন করাটাও জরুরি। সঙ্গে উদাহরণ লিপিবদ্ধ করা ফাইল রাখা উচিত যেখানে কর্মীর কাজ সম্পর্কে অভিযোগ রয়েছে। হাকিম বলেন, ‘যদি কর্মী আপনার সঙ্গে তর্ক করার চেষ্টা করে তাহলে অবশ্যই আপনি বলবেন, আমি সম্মানপ্রদর্শনপূর্বক দ্বিমত করছি। এখানে ১৩ ধরনের অভিযোগ আছে। একজন ক্রেতা অভিযোগ করেছেন আপনি পণ্যটি ডেলিভারি দিতে তিন সপ্তাহ দেরী করেছেন।’ এভাবে স্পষ্টভাবে বিষয়গুলো সম্পর্কে সরাসরি খোলাখুলিভাবে বলুন।
জিজ্ঞেস করুন কিভাবে সাহায্য করতে পারেন
একজন কর্মীর পারফরম্যান্স খারাপ হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। এটা হতে পারে পারিবারিক জটিলতা যা কর্মক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করছে। এটা হতে পারে যে কর্মী কোনো কাজ নিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে গেছে অথবা কাজের ক্ষেত্রে কোনো অতিরিক্ত চাপ নিয়ে ফেলছে অথবা একই ধরনের কাজ বিরক্তি ধরিয়ে দিচ্ছে যা তার কাজের গতিকে কমিয়ে দিচ্ছে। অনেক সময় কর্মীরা তাদের প্রতি প্রত্যাশার মাত্রা সম্পর্কে অবগত থাকে না। তারা যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে সে সম্পর্কেও কর্মীরা জানে না। যাইহোক, আপনি কর্মীর সমস্যার মূলে গিয়ে তার সমাধান করতে পারেন। এবং কর্মীকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারেন।
‘এ কথোপকথনটা এমন হবে না যে, আপনি শুধু আপনার অভিযোগগুলো কর্মীকে জানাবেন। উভয়ের মধ্যে আলোচনা হবে। কর্মীর কথাও আপনাকে শুনতে হবে। আপনি এভাবে বলতে পারেন, ‘আমি লক্ষ্য করেছি আপনি যথেষ্ট পরিমাণ লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হচ্ছেন। আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’ বলেন ডায়ার।
পরবর্তী করণীয় ঠিক করে দিন
একবার যখন আপনি আপনার কর্মীকে নিশ্চয়তা দিবেন আপনারা উভয়েই একঅবস্থানে আছেন, তখন আপনার উচিত একটি শক্তিশালী কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে দেওয়া। সহানুভূতিশীল হোন, তবে আবার লক্ষ্য পূরণে যেন ব্যর্থ না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখুন৷
যেমন, যদি কোনো কর্মী কাজের চাপ কাটিয়ে উঠতে সংগ্রাম করে অথবা কাজটি করার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মদক্ষতা না থাকে তাহলে আপনি প্রতিষ্ঠান কতৃক প্রদত্ত প্রশিক্ষণ নিতে সহায়তা করতে পারেন৷ অথবা যদি বলে যে, পারিবারিক সমস্যায় ভুগছে তাহলে আপনি কিছুদিনের ছুটি দিতে পারেন অথবা সমস্যা সমাধানের পূর্ব পর্যন্ত দলীয় কাজকে বাকিদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে সমস্যায় জর্জরিত ব্যক্তিকে তার সমস্যা মিটিয়ে পুরোদমে কাজে মন দেয়ার সুযোগ করে দিতে পারেন।
হাকিম বলেন, এভাবে বলুন- ‘আমি আপনার পরিস্থিতি শুনে সত্যিই দুঃখিত। অফিসে সফল হওয়ার জন্য আমি আপনার জন্য কি করতে পারি? পরিস্থিতি মোকাবেলায় আপনার কি ছুটি দরকার?’
উন্নতির জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিন
চূড়ান্ত সময় খুব কমই অনুপ্রেরণা দেয়। কিন্তু একজন ধুঁকতে থাকা কর্মীর এটা জানা দরকার যদি সে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয় তাহলে তার পরিণতি কি হবে।
‘আমি বলব, এই মাসের শেষে যদি বিষয়গুলোর উন্নতি না হয়, অথবা আপনার জীবন/কাজ এর ব্যালেন্স যদি ঠিক না হয়, তাহলে সেই সময়ে বিষয়গুলোকে আবার পূণঃমূল্যায়ন করা হবে।’- এটিতে হুমকি কম। এভাবেই কর্মীর সাথে আলাপ করতে হবে বলেন ডায়ার।
হাকিম একমত পোষণ করে বলেন, এটা বলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, ‘আমি আশাবাদী যে আমরা এখানে সবশেষে একটি ইতিবাচক ফল পাবো। তবে আপনাকে এটাও জানাচ্ছি যে, আমরা আগামী এক সপ্তাহ অথবা তিনমাস যাবত আপনার কাজ দেখবো। দেখবো আপনি কেমন কাজ করছেন। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পেরেছেন কিনা। যদি না পারেন সেক্ষেত্রে তখন আলোচনা করে অন্য সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।’
সবশেষে কথা হচ্ছে, ব্যবসা হচ্ছে অর্থ উপার্জন করার জন্য এবং কর্মীটি এখানে আছে কাজ করার জন্য। কিন্তু যদি তারা তাদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, উন্নতি না করতে পারে তাহলে এই কাজের জন্য আর তারা যোগ্য নয়।
কর্মীকে ফলো আপ করতে বলুন
আপনি যতই স্পষ্ট ও সহানুভূতিশীল হোন না কেন, কাজ নিয়ে উদ্বেগ আপনার কর্মীকে আপনার সব উপদেশ ভুলিয়ে দিতে পারে। তাই আপনি সমস্যা চিহ্নিত করার পর রুপরেখা তৈরি করুন। একে অপরকে বুঝতে পেরেছেন তা নিশ্চিত করুন।
হাকিম এমন কিছু বলার পরামর্শ দিয়েছেন, ‘আমার কথা শোনার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি জানি এই অফিসে আসার পরে যা শোনার আশা করেছিলেন এই বার্তাটি সেরকম না। আমরা একই সাথে আছি সেটি নিশ্চিত করার জন্য আমাদের কথোপকথন এর মূলভাব ই-মেইলে আমাকে পাঠাবেন। এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে মূলভিত্তিকে স্পর্শ করবেন তা নিশ্চিত করবেন।’
আপনারা শুধু যে একটা সমঝোতায় পৌঁছাবেন তা নয় বরং এর একটি দালিলিক প্রমাণপত্রও রেখে দিবেন যদি কখনো আপনার প্রয়োজন হয়।
তথ্যসূত্র : ফোর্জ ডট মিডিয়াম