দেশজনতা অনলাইন : গত ৩১ জুলাই ডেঙ্গু টেস্টে ১২ বছরের জারার পজিটিভ রিপোর্ট আসে। কিন্তু তার প্লাটিলেটসহ অন্যান্য সবকিছু স্বাভাবিক থাকাতে চিকিৎসক জারাকে হাসপাতালে ভর্তি নেননি। প্রেসক্রিপশনে বয়স ও ওজন অনুযায়ী দৈনিক কয়েক লিটার লিকুইড খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বাসাতেই তার চিকিৎসা চালানোর কথা বলেন চিকিৎসক। তার বাবা-মাকে বলে দেন নিয়মিত প্লাটিলেট পরীক্ষাসহ আর কী কী করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শমতো সেভাবেই বাসায় প্রচুর লিকুইড খাওয়ানোসহ অন্যান্য নিয়ম মেনে চলায় জারা সুস্থ হয়ে ওঠে দিন সাতেক পরেই।
একইভাবে গণমাধ্যমকর্মী হাসান ইমামের সাত বছরের সন্তান সৌরজ্যোতি ইসলামের ডেঙ্গু টেস্ট করালে রিপোর্টে এনএসওয়ান পজিটিভ আসে। তাকেও হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়নি। চিকিৎসক কেবল নাপা ট্যাবলেট, প্রচুর লিকুইড খাবার আর বমিভাব থাকায় তাকে বমির জন্য ওষুধ দেন। সেই সঙ্গে দুইদিন পরপর শিশুটির প্লাটিলেট টেস্ট চলতে থাকে। বাসাতেই সঠিক নিয়ম মেনে সাত বছরের এই শিশুটিও সপ্তাহখানেকের মধ্যে রোগমুক্ত হয়।
এ দুটি ঘটনা উদাহরণ মাত্র। এমন অসংখ্য মানুষ এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েও হাসপাতালের বদলে বাসাতেই চিকিৎসা নিয়েছেন। অন্য জটিলতা না থাকায় তাদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি।
বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডেঙ্গুর এই সময়টাতে যত মানুষ রক্ত পরীক্ষা করে পজিটিভ প্রমাণিত হয়েছেন তাদের বেশিরভাগকেই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়নি। যাদের অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল না তাদের হাসপাতালে ভর্তি না করে বাসাতেই চিকিৎসা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এদের সিংহভাগই বাসায় চলা চিকিৎসাতেই সেরে উঠেছেন। হাসপাতালে শয্যাশায়ী হতে হয়নি তাদের। তবে সেরে উঠলেও এসব রোগীর তথ্য নেই সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট বিভাগে। তাই চলতি বছরে সর্বমোট কত রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন সে তথ্যও সরকারের কাছে নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে ডেঙ্গু সংক্রান্ত যে রিপোর্টগুলো আসে তাতে ঢাকার শহরের ১২টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত আর ২৯ টি বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য থাকে। এর বাইরে কোনও ডেঙ্গু রোগীর তথ্য তাদের কাছে থাকে না, তাই মোট রোগীর সংখ্যা তাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। ঢাকার বাইরেও নির্দিষ্ট হাসপাতালগুলোর বাইরে ঘরে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা তাদের হাতে নেই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ও চিকিৎসক বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেঙ্গু সেলেই যদি গত ১০ দিনে ১০ হাজার টিকিট বিক্রি হয়ে থাকে তাহলে ধরতে হবে এ সংখ্যা আরও বেশি। কারণ, ডেঙ্গু সেলে টিকিট বিক্রি শুরু হয় দুপুর আড়াইটা থেকে, ততক্ষণে হাসপাতালের বহির্বিভাগ বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকে সেলের টিকিট বিক্রি চলে পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত অর্থাৎ পরের দিন বহির্বিভাগ খোলার সময় পর্যন্ত।
আর এই ১০ হাজার টিকিট বিক্রি হলেও হাসপাতালে কিন্তু ভর্তি হয়েছেন এক হাজারের মতো ডেঙ্গু রোগী। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২২ আগস্ট পর্যন্ত বহির্বিভাগে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা নিয়েছেন পাঁচ হাজার ৫০৫ জন, এই রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হননি। অর্থাৎ ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যাটা স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে যাচ্ছে না, তাদের কাছে যাচ্ছে কেবলমাত্র হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর সংখ্যা।
চিকিৎসকরা বলছেন, একজন ডেঙ্গু রোগী যদি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকেন তাহলে বাসায় চিকিৎসা নিয়েছেন পাঁচজন, এমনকি এ সংখ্যাটা ২০জনও হতে পারে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী যদি আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ হাজার হয় তাহলে মোট আক্রান্তের সংখ্যা এর ২০ গুণ বেশি হবে।
তাই হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দিয়ে কখনোই মোট আক্রান্তের হিসাব করা যাবে না বলছেন চিকিৎসকরা।
চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর বলেন, সাধারণ জ্বরে কাউকে ভর্তি করানো হয় না, কিন্তু ভর্তি যাদেরকে করাতেই হবে তাদেরকে অবশ্যই ভর্তি করানো হয়েছে। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে যাদের ভর্তি দরকার হচ্ছে না, যারা বাড়িতে থেকেই পুরো ম্যানেজমেন্টটা করতে পারবে তাদের ভর্তি করানোর দরকার হয় না আসলে। যাদের কেবল ফ্লুইড সাপোর্ট লাগছে তাদেরকে ভর্তি করানোর দরকার হয় না। সে হিসেবে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর দরকার হয়েছে, বাকিদের বাসাতেই চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
গত ২৭ জুলাই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা করে চালু হয় ডেঙ্গু সেল। তবে তারও আগে থেকে হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগীরা আসতেন চিকিৎসা নিতে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের আরপি সহকারী অধ্যাপক ডা. হাসান ইমাম জানান, প্রায় প্রতিদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্হিবিভাগে প্রায় ৪০০ জন এসেছেন জ্বর নিয়ে, তাদের অধিকাংশই ছিলেন ডেঙ্গু আক্রান্ত। তবে তাদের বেশিরভাগকেই ভর্তি করানোর প্রয়োজন হয়নি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দীন বলেন, গত সাড়ে তিনমাসে পাঁচ হাজার ৬৯৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে। এছাড়া নিদেনপক্ষে আরও অন্তত পাঁচ হাজার রোগী বিভিন্ন মাইনর সিম্পটম নিয়ে এসেছিল যাদেরকে আমরা বহির্বিভাগ থেকে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। এবং তাদের সংখ্যা অবশ্যই পাঁচ হাজারের ওপরে হবে—এতে কোনও সন্দেহ নেই।
যতো ডেঙ্গু রোগী এসেছে হাসপাতালে সবাইকে কী ভর্তি নেওয়া হয়েছে কীনা প্রশ্নে এ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শাইখ আব্দুল্লাহ বলেন, সবাইকে ভর্তি নেওয়া হয়নি। সেটা শতকরা হিসেবে ধরলে প্রতিদিন ডেঙ্গু পজিটিভ রোগীদের মধ্যে ৭০ জনকেই বাসায় চিকিৎসা নেওয়ার কথা বলে ফেরত পাঠানো হয় আর ত্রিশজনকে ভর্তি নেওয়া হয়েছে। ফেরত দেওয়া রোগীদের কোনও জটিলতা ছিল না বলেই তাদেরকে ভর্তি নেওয়া হয়নি।
ডেঙ্গু রোগীদের সংখ্যা নিয়ে কাজ করা স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার এ সম্পর্কে বলেন, শুধু হাসপাতালের ভর্তি রোগীর সংখ্যাই আমাদের কাছে আসে আর সে সংখ্যাটাই সরকারি হিসাব বলে গণ্য হয়। বহির্বিভাগে যেসব রোগী আসে তারা অনেকেই চিকিৎসা নিয়ে চলে যায়। তাই যারা বাসায় চিকিৎসা নিয়েছে তাদেরতো ‘আইডেন্টিফাই’ করতে পারবো না। তবে ভবিষ্যতে আমরা বহির্বিভাগের রোগীদেরও কীভাবে হিসাবে আনা যায় সে নিয়ে কাজ করছি, হয়তো আগামী বছরে সেটা করতে পারবো।