গত সোমবার (৫ আগস্ট) ভারত সরকারের নাটকীয় ঘোষণার মাধ্যমে কাশ্মিরের সায়ত্তশাসন বাতিল ও দুটি অঞ্চলে ভাগ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর অঞ্চলটির মূল শহর শ্রীনগর সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। শ্রীনগরের খালি রাস্তায় ওষুধ কেনার চেষ্টায় বের হওয়া নুসরাত আমিন বলছিলেন, ‘আমাদের জীবন বদলে যাবে। এটা অবিচার। তবে আমরা পথে নামবোই, নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আমরা বাধ্য’।
পরিবির্তত পরিস্থিতিতে কাশ্মিরের সংবিধান ও পতাকা বিলুপ্ত হবে। যে আইনের অধীনে বাইরের লোক এখানে ভূমি কিনতে পারতো না তাও বাতিল হয়েছে। অনেক কাশ্মিরি আশঙ্কা করছেন রাজ্যের জসংখ্যাতাত্ত্বিক বাস্তবতা বদলে যাবে, জীবনযাপনে আসবে পরিবর্তন। কাশ্মিরিদের কণ্ঠস্বর প্রায় সম্পূর্ণভাবেই স্তব্ধ দেওয়া হয়েছে। সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই এই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষকে কঠোর কারফিউ-এর মধ্যে বন্দি করা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় যোগাযোগের সব উপায়। আবাসিক এলাকায় বাড়ির বাইরে পার্শ্বরাস্তায় যেখানে অল্প কয়েকজন মানুষও একজায়গায় বসতে পারছেন সেখানেও ক্ষোভ আর বিশ্বাসঘাতক পদক্ষেপের শিকার হওয়ার তীব্র অনুভূতির খোঁজ মিলছে।
বিবিসির সাংবাদিক গীতা পাণ্ডে ২দিন সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করেছেন কাশ্মিরের ঘটনাবলী। সেখান থেকে ফিরে তিনি শ্রীনগর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত কানহার অঞ্চলের অভিজ্ঞতা লিখেছেন, যে এলাকাটি ভারতবিরোধী বিক্ষোভের জন্য বিখ্যাত। গীতা লিখেছেন, কার্যত ২৪ ঘণ্টার কারফিউ জারি থাকা ওই অঞ্চলে পৌঁছাতে তাদেরকে আধা ডজন খানেক নিরাপত্তা চৌকি পেরোতে হয়েছে। আরেকটি ব্যারিকেড পেরিয়ে তিনি নিজের কার থেকে নামেন ছবি তোলার জন্য। মুহূর্তেই কিছু মানুষ দৌঁড়ে গীতার কাছে আসে। অভিযোগ করে তাদেরকে এভাবেই অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ‘সরকার আমাদের সঙ্গে দস্যুবৃত্তি করেছে’, প্রবীণ একজন অভিযোগ করেন বিবিসির প্রতিবেদক গীতা পাণ্ডের কাছে।
গীতা লিখেছেন, ‘আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যরা আমাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল তবে সেখানে থাকা একজন তাদের উদ্দেশে বলে যাচ্ছিলেন, ‘তোমরা দিনেও আমাদের অবরুদ্ধ করে রাখছ, রাতেও আমাদের অবরুদ্ধ করে রাখছ’.. পুলিশ সদস্যটি তখন তাদেরকে কারফিউয়ের কথা মনে করিয়ে দিয়ে হুমকি দেয়, এক্ষুণি তোমাদের ঘরে ফিরে যাওয়া উচিত। তবে সেই প্রবীন ব্যক্তি ফিরতে চাইছিলেন না। নিরাপত্তা রক্ষীর সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করছিলেন তিনি। এমন সময় পুলিশের পক্ষ থেকে গীতাকে স্থান ত্যাগ করতে বলা হয়। ঠিক সেই সময় নিজের শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে সেদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন একজন তরুণ। বিবিসি সাংবাদিক গীতাকে তিনি বলেন, ‘এ আমার একমাত্র সন্তান। এখন ও খুব ছোট, তবে আমি তাকে অস্ত্র চালানো শেখাব।’ গীতা লিখেছেন, তিনি এতোটাই ক্ষুব্ধ যে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ সদস্যদের সামনে যে তিনি এসব কথা বলছেন, সে ব্যাপারে কোনও খেয়াল ছিল না তার।
অনেকেই অভিযোগ করেছেন ভারত কাশ্মিরের ভূমি চায়, কাশ্মিরি জনগণকে নয়। নিজেকে কাশ্মিরের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দেওয়া মোহাম্মদ রফিক দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘তারা বলছে কাশ্মির আমাদের, কিন্তু একই সময়ে তারা আমাদের হত্যা করছে। এখানে তারা যা কিছু করছে তার সবই ক্ষমতা ও জোর করে করছে’।
কারফিউ আর নিরাপত্তা বাহিনীর প্রবল উপস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে শ্রীনগর। তবে সাম্প্রতিক নিস্তব্ধতা আরও অনেক বেশি গভীর। লাঠি হাতে থাকা জম্মু কাশ্মির পুলিশ কর্মকর্তারা রাইফেল আর হেলমেটধারী ভারতের কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। রিজার্ভ পুলিশের এসব কর্মকর্তাদের অনেকেই হয়তো আগে কখনোই কাশ্মির দেখেনি। তারাও ছড়িয়ে আছে প্রত্যেকটি কোনায়। রফিক বলেন, জানালা দিয়ে শিশুরা বাইরে তাকলেই ভারী অস্তে সজ্জিত ভারতীয় বাহিনীকে দেখতে পাচ্ছে। তার মনের ওপর এটা কী ধরণের প্রভাব ফেলছে? কাশ্মিরের জনগণকে ভালোবাসা নাকি বন্দুক ও ক্ষমতা দিয়ে জিতে নিতে চান?
শুক্রবার পুলিশের তরফে কারফিউ সাময়িকভাবে তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয় যাতে করে মানুষ জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যেতে পারে। মার্কিন বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস এর খবর অনুযায়ী নামাজের পরে কিছু বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বার্তা সংস্থাটি জানিয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়া শুরু করে মানুষ। আধাসামরিক বাহিনী টিয়ার গ্যাস ও ছররা গুলি নিক্ষেপ করে তার জবাব দেয়।
নামাজ শুরুর আগে ছররা ও রাবার গুলিতে আহত অন্তত ৫০ জনকে শ্রী মহারাজা হরি সিং হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে শুক্রবারের বিক্ষোভের পর আরও কতজনের চিকিৎসার প্রয়োজন পড়েছে তা জানা যায়নি। সহিংসতা ঠেকাতে শত শত রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এদের অনেককেই সাময়িক আটককেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বিবিসির সাংবাদিক গীতা পাণ্ডে সরেজমিন শ্রীনগর ঘুরে দেখেছেন, কয়েকটি রাস্তায় পড়ে রয়েছে ভাঙা ইটের টুকরো। তার ধারণা, সরকারি বাহিনীর ওপর পাথর ছোঁড়া কোনও গ্রুপ হয়তো সেগুলো ফেলে গেছে। সন্ধ্যার অন্ধকারে টিয়ারগ্যাস ছোঁড়ার শব্দ শুনেছেন তিনি। জানিয়েছেন, বিপুল সামরিক উপস্থিতির মধ্যেও বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
আরোপিত বিধিনিষেধ উঠে গেলে কাশ্মিরের জনগণ তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাবে বলে ধারণা করছেন জম্মু কাশ্মির পিউপিলস কনফারেন্সের মুখপাত্র আদনান আশরাফ। তিনি গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ‘আমি নিশ্চিত কাশ্মিরিরা বিস্ফোরিত হবে।’