২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৭:৫৫

শিকড়ের রস

সাহিত্য ডেস্ক:

গ্রামে আসার পর দাদিকে জড়িয়ে ধরে পিয়া যে সহাস্য সেলফি তুলে, ফেইসবুকে পোস্টের সময় তাতে স্ট্যাটাস দিয়েছে: আমাদের দুজনের মধ্যে ব্যবধান আকাশ-পাতাল তবু অশীতিপর এ বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরে মন অনাবিল সুখে ভরে ওঠে কেন?

ফেইসবুকে পিয়ার বন্ধু সংখ্যা এখন চার হাজারের উপরে। দাদির সেলফিতে লাইক দিয়েছে বিরানব্বই জন, পরিচিত ঘনিষ্ঠদের মধ্যে শেয়ার করেছে এবং মন্তব্য করেছে আটজন। পিয়ার ধাঁধার জবাব দিতেই যেন এক আত্মীয়-বন্ধু লিখেছে, রক্তের টান। আরেক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ঠাট্টা করেছে, তোমার দাদি যৌবনে তোমার মতো সুন্দর ছিল। জার্মানিতে পিয়ার সহপাঠী আফ্রিকান বান্ধবী ইংরেজিতে লিখেছে, শিকড়ের টানে দেশে ফিরলে। এখন কোথায় কার সঙ্গে সুখী সময় কাটাচ্ছ পিয়া? পিয়ার টার্কিশ বন্ধু মাহমুদও বাংলায় লেখা স্ট্যাটাস বোঝেনি, কিন্তু দাদির ছবি খুঁটিয়ে দেখে মন্তব্য করেছে, এই বয়সেও কোঁচকানো মুখে লাজুক হাসিটা অসাধারণ। দেশে ফিরে ওল্ড লেডির সঙ্গে লিভ টুগেদার করছো এখন?

অধিকাংশ মন্তব্য ও প্রশ্নকারীকে রিপ্লাই দিয়েছে পিয়া। স্মার্টফোনের স্ক্রীনে দাদিকে তার ছবি দেখিয়ে বলেছে, আমার সঙ্গে তুমিও ইন্টারনেটে উড়ে গেছ গোটা দুনিয়ায়। দেশবিদেশে হাজার হাজার মানুষ দেখছে তোমাকে। পছন্দও করেছে অনেকে।কোন মানুষ দেখছে আমাকে? ফেইসবুকে আমার প্রায় পাঁচ হাজার বন্ধু আছে। তারা ছাড়াও কতো মানুষ দেখবে।

বুড়ি দাদি ইন্টারনেট ফেইসবুক বোঝে না। নাতনির পাঁচ হাজার বন্ধু থাকার বিষয়টিও অবিশ্বাস্য। হাতের লাঠি উঁচিয়ে বলে, নিশ্চয় জিনপরির আছড় আছে তোর উপর। কোন দেশ থেকে উড়ি আসলি তুই! এখন আমাকেও নিয়াও উড়তে চাইস?

পিয়ার শৈশবে দাদি ঢাকায় ছেলের বাসায় বেড়াতে গেলে নাতনির ঘরে থাকত। গল্প শুনতে চাইলে জিন-পরি, ভূত-প্রেতসহ গাঁয়ের আজগুবি সব গল্প শোনাত পিয়াকে। দাদির সেসব গল্প শুনে ছোটবেলায় দাদির সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে আসার বায়নাও ধরেছিল পিয়া। এবার বিদেশে ওড়ার আগে দাদিকে দেখতে গ্রামে আসার পেছনে বাপদাদার ভিটেবাড়ি ও জন্মভূমি নতুন করে দেখার আগ্রহ কিছুটা কাজ করেছে হয়তো, কিন্তু ছোটবেলায় শোনা সেইসব গল্পের ভয়ঙ্কর জীব মিথ্যে হয়ে গেছে কবেই! নিজের গল্প বলে দাদিকে সে আজ উল্টো ভয় দেখায়।

ও দাদি, ছোটবেলায় তোমার মিথ্যে গল্প শুনে একা বাথরুমে যেতেও ভয় পেতাম। আর এখন দেখ বার্লিন-প্যারিস-লন্ডন কতো জায়গায় একা একাই উড়ে যাই। গোটা দুনিয়াটা আমার এই ফোনে হাতের মুঠোয় বন্দি। তোমার ভূয়া জিন-পরির চেয়েও আমার ওড়ার ক্ষমতা বেশি।

পরির গল্প মিছা বলছি আমি! বিদেশে থাকিয়া খ্রিস্টান হইছিস তুই, আল্লাহ-রসুলকেও মানিস না! জিনপরি আছে কি নাই, আয় তোকে এখনই প্রমাণ দেখাই।

কোমর হেলে গেছে, সোজা দাঁড়াতেও পারে না, তবু লাঠিতে ভর দিয়ে সারাবাড়ি ঠুকঠাক করে হাঁটতে ভালবাসে বুড়ি। চশমা চোখে গাঁয়ের যে কোনো মুখ চেনে, কানেও শুনতে পায় পরিষ্কার। পিয়া আসার পর বয়স আরো কমেছে যেন। পরি দেখানোর জন্য নাতনিকে বাড়ির বাইরে ভিটার কাঁঠাল গাছতলায় টেনে আনে। পড়শি এক গরিব বাড়ির দিকে লাঠি উঁচিয়ে বলে, ওই দেখ, ওইটা আব্দুলের বাপ কাছুর বাড়ি। কাছু যখন খুব ভোরে কি চাঁদনি রাইতে বাড়ির বাইরে একা ঘোরে, পরি ভর করে তার উপর। চিল যেমন চড়ুইর বাচ্চা, তেমনি কাছুকেও ছোঁ দিয়া পরিস্থানে উড়াল দেয়। এক দেড় মাস কোনো হদিস থাকে না কাছুর। তারপর একদিন ভোরবেলা কাছু বাড়ির পিছের বড় গাছটা থাকি নামে। হাতের একটা ব্যাগে পরিস্থানের মিঠাইমণ্ডা। আর একবার খালইভরা মাছ নিয়া আসছে, তেমন রঙিন মাছ এ দেশের নদীনালায় হয় না। পরি কাছুকে বাড়িতে দিয়া গেলে দেখার জন গ্রামের কতো মানুষ ছুটে যায়, আমিও গেছি।

দাদির সত্য গল্প শুনে পিয়ার ইচ্ছে হয়, এক্ষুণি পড়শি পরিধরা কাছুর মুখোমুখি হয়ে তার পরির গুমোড় ভেদ করে। প্রমাণ দিতে কাছুকে ডাকার জন্য লোক খোঁজে বুড়ি। বাড়ির কাজের লোক এসে ভুল ভাঙায়, কাছু মরে গেছে সেই কোনকালে! ডাকলে কি সে কবর থেকে উঠে আসবে? তবে দাদি মিছে বলেনি, গ্রামের অনেকেই জানে পরিধরা কাছুর গল্প এবং কাছুর ছেলে আব্দুলকে ডাকলেও প্রমাণ হবে। পরির রহস্য জানার চেয়ে পিয়া দাদির স্মৃতিজগত নিয়ে ভাবে। এই বয়সেও বুড়ির স্মরণশক্তি এতটা প্রখর যে, হারানো অতীত চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠলে কালবিভ্রম ঘটে। পিয়ার ছোটবেলার নানা ঘটনাও দাদির স্মৃতিতে পরির মতো উড়ে এসে নৃত্য শুরু কলে মুখে হাসি ফোটে তার। জানতে চায় সে, মনে নেই তোর পিয়া, গ্রামের বান্দর ছেলেমেয়েদের সাথে খেলতে গিয়ে একবার গাছে গিয়ে উঠলি, তারপর নামতে না পেরে কী কান্না। কও তো দেখি কোন গাছ সেটা?

দুই যুগ আগে বাবামায়ের সঙ্গে গাঁয়ের বাড়িতে আসার স্মৃতি অনেক কিছুই ভুলে গেছে পিয়া। কিন্তু একটা বড় ফুল গাছের মোটা কান্ড বেয়ে প্রায় দশ ফুট উঁচুতে উঠে নামতে না পারার স্মৃতি-ভয়টা ভোলেনি এখনো। গাছের কান্ডটাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে কাঁদতে শুরু করেছিল। বড় হয়েও অনেক উঁচু থেকে নিচে পতনের দুঃস্বপ্ন গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু দাদি ঘটনাটা মনে রেখেছে কেন? পিয়ার কান্না শুনে সেই প্রথম বাড়ি থেকে ছুটে এসেছিল বলে, নাকি গাছটার সঙ্গে দাদাকেও দেখতে পায় এখনও?

বাড়ির সামনের খোলানে এসে দাদি সেই চাপাগাছটা দেখিয়ে দেয়। গাছটা ঝড়ে ভেঙে পড়েছিল একবার, শিকড় মাটির গভীরে চলে গিয়েছিল বলে উপড়ানো গোড়ালি থেকে নতুন গাছ হয়েছে। কান্ডবহুল গাছটির একদম উপরের দিকে কিছু লম্বা-চেপ্টা পাতা, পতার ফাঁকে সাদা ফুল। এই বুনো চাপাগাছটি ছাড়াও দাদা বাড়ির সামনে বাগান করতে অনেক ফুল ও ফল গাছ লাগিয়েছিল। সেসব গাছের অধিাকংশ মরে গেছে, কিন্তু বুড়ি চাপা গাছের নিচে এখনো জোয়ান স্বামীকে দেখে হেসে মন্তব্য করে, তোর দাদার কাণ্ড দেখ! ক্ষেতের ধানপাটের খোঁজ নাই, কিন্তু বাড়ির সামনের বাগানে ফুলফলাদির গাছ লাগায়। ভিটায় গোবর সার দিয়া লাল শাক আর পালং শাকের বিচিও ছিটায়। কতোরকম তরকারি হয় এই ভিটায়।

পিয়া মাটিতে পড়ে থাকে একটি চাপা ফুল কুড়িয়ে নাকে ধরে, ফুলের গন্ধের সঙ্গে শৈশবে দাদির মাথা থেকে পাওয়া কদুর তেলের অদ্ভুত গন্ধটাও ফিরে আসে যেন। ফুলটা ছুড়ে দিয়ে দাদিকে স্মৃতির জগত থেকে ফেরাতে বলে, ও দাদি, তুমি আমার বিয়ের জন্য গ্রামেই বর ঠিক করবে বলছিলে? দেখাও সেই পাত্র, পছন্দ হলে তাকে নিয়েই উড়ে যাব।

উড়তে তোকে আর দেব না। আগে আয় দেখি, নওশেরের বউ কী রাঁধে তোর জন্য।

দাদার মৃত্যুর পর গ্রামের বাড়িতে দাদি একা হয়েছে। ছেলেমেয়েরা সবাই শহরে, যে যার সংসারে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাদের কারো পক্ষে গ্রামের বাড়িতে বছরে এক আধবার এসে মাকে দুএকদিনের বেশি সেবা ও সঙ্গ দেয়া সম্ভব নয়। এ কারণে বুড়ি মাকে নিজেদের বাসায় রাখার চেষ্টা করেছে সবাই। কিন্তু গ্রামের মুক্ত আলো-বাতাস আর স্মৃতির ছায়ায় ঘেরা এ বাড়ি ছেড়ে শহরের বদ্ধ বাসায় গিয়ে বেশিদিন মন টেকে না বুড়ির। বছর তিনেক আগে পিয়াদের ঢাকার বাসা থেকে গাঁয়ে ফেরার সময়ে বাসে বমি করে এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল যে, পথেই তার শেষ নিশ্বাস ছাড়ার ভয় জেগেছিল যাত্রাসঙ্গী নওশেরের মনে। তার মৃত্যুর দায় এড়ানোর জন্য বুড়ির ছেলেমেয়েদের কাছে ফোন করে খবরটা জানিয়েছে সে। যাত্রাবিরতি দিয়ে নিকটের হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিল তারা। কিন্তু দাদি জীবিত বা মৃত বাড়িতে পৌঁছার সিদ্ধান্তে অটল ছিল। অগত্যা মাকে শেষ দেখার জন্য তড়িঘড়ি মায়ের পিছু নিয়েছিল পিয়ার বাবা ও দুই ফূফু। পিয়া তখন জার্মানিতে। বাবার ফোন পেয়ে দাদি মরে গেছে ধরে নিয়ে কাঁদতে শুরু করেছিল সে। কিন্তু সেই যাত্রায় বেঁচে গেলেও পরোলোকযাত্রা ত্বরান্বিত করতে ছেলেমেয়েদের কাছে অন্তিম ইচ্ছে জানিয়েছে দাদি, জীবন থাকতে এ বাড়ি ছেড়ে আর নড়চড় করবে না। কবরে ঢোকার আগে পর্যন্ত স্বামীর কবর ঘেঁষে গ্রামেই পড়ে থাকবে।

ছেলেমেয়েরাও মেনে নিয়েছে মায়ের সিদ্ধান্ত। অশক্ত শরীর নিয়ে ছোটাছুটির বদলে এক জায়গায় থাকাই ভালো। দৈনন্দিন খোঁজখবর নেয়ার জন্য মোবাইল ফোন কিনে দেয়া হয়েছে, ফোনে নিজেদের নাম-নাম্বার সেভ করে দিয়েছে স্বজনরা। গাঁয়ের বাজারেও এখন এমবিবিএস ডাক্তার আছে একজন, তাকেও বিশেষভাবে বলা হয়েছে। মায়ের অসুস্থতার খবর পেলেই সে ছুটে আসবে। তাছাড়া বড় ধরণের অসুখ হলে অ্যাম্বুলেন্সে জেলা শহরের হাসাপাতালেও নেয়া যাবে ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে। সর্বোপরি, মায়ের সেবাযত্ন ও একাকিত্ব ঘোচাতে বাড়িতে আশ্রয় দেয়া হয়েছে দীর্ঘদিনের পরিচিত ও নির্ভরযোগ্য কাজের লোক নওশেরকে। সপরিবার পাকাবাড়িতে মাগনা বসবাসের সুযোগ ছাড়াও নওশের বাড়ির কিছু কৃষিজমি চাষাবাদ করে। তার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে সবাই বুড়ি মায়ের সেবাযত্ন করতে বাধ্য। এতকিছুর পরও বছরে অন্তত দুএকদিনের জন্য ব্যস্ত ছেলেমেয়েরা বুড়ি মাকে দেখতে গ্রামের বাড়িতে ছুটে আসে। আর মৃত্যু সংবাদ পেলেই আটদশ ঘণ্টার মধ্যে মায়ের লাশের পাশে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি তো সবার আছেই। কিন্তু বিদেশ থাকার কারণে পিয়ার পক্ষে ছুটে আসা সম্ভব হবে না। কাজেই কবরযাত্রী দাদিকে শেষ দেখা ও শেষ বিদায় নেয়ার জন্যই আসলে তার গ্রামে আসা।

প্রবাসজীবনের একাকিত্বে যখন দেশের টান ও স্বজনদের স্মৃতি মনে পড়ে নানা সূত্রে, ফোনে কিংবা স্কাইপে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময়ে দাদির কথাও মনে পড়েছে পিয়ার। কী এমন টান, নাকি শহুরে সন্তানদের উপর অভিমান, যার জন্য মরণকালে আপন জনদের সান্নিধ্য উপেক্ষা করে স্বামীর ভিটাবাড়ির একাকিত্ব বেছে নিয়েছে বুড়ি? জার্মানিতে ভ্যাকেশনে তিন মাসের জন্য একটি বাড়িতে হাউসকিপিং-এর চাকরি নিয়েছিল পিয়া। বাড়িতে একজনমাত্র মানুষ, নব্বই বছরের এক বৃদ্ধা এবং তার পোষা কুকুর। ছেলেমেয়েরা দেশে-বিদেশে সবাই আলাদা, এক ছেলের পরিবার বুড়ির বাড়ির কাছেই আলাদা ফ্ল্যাটে থাকত। কিন্তু তিনমাস কাজের সময় বুড়ির ছেলেমেয়ে ও নাতিনাতনিদের কাউকে একবারও আসতে দেখেনি। জার্মান ভাষাটা তখনও সম্পূর্ণ আয়ত্তে না আসায় বৃদ্ধাকে সঙ্গ দিতে পারেনি পিয়া, তবে ভাঙা বোল ও ইশারা ভাষায় নিজের দাদির কথা শোনাতে চেয়েছিল। জার্মান বুড়ি যে কী বুঝে মাথা নাড়িয়েছে, তা সেই জানে। দেশে ফেরার পর জার্মানির বদ্ধার গল্প বলে পিয়া বাবার কাছে জানতে চেয়েছিল, হাউজ কিপারের কাজ করে আমি তিনমাসে যে ইউরো ডলার পেয়েছি, তা দিয়ে ইউনিভার্সিটির খরচ অনেকটাই মিটেছে। তোমরা গ্রামের বাড়ির কেয়ারটেকারকে কত বেতন দাও বাবা?

আমরা নওশেরক বেতন না দিলেও অনেক সুযোগসুবিধা দিচ্ছি। কিন্তু এতকিছুর পরও নওশেরের পরিবার মাকে ঠিকমতো দেখে না কেন, তুই এবার গ্রামে গেলে একটু ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখিস পিয়া। পাড়াপড়শি লোকজনকেও একটু বলে আসবি।

দাদি ছাড়া গ্রামবাসী সবাই পিয়ার অচেনা। শৈশবে এসে যাদের দেখেছে, তাদের কারো মুখ তেমন মনে নেই। চাপা গাছে ওঠার স্মৃতিটা ছাড়া বড় শিংঅলা গরু দেখে ভয় পাওয়া এবং একটি এ্যাঁদো ডোবায় গায়ে কাদাপানি মেখে মাছধরা একটি মেয়ের মুখ মনে পড়ে। সেই মেয়ে হাতে বড় একটা টাকি মাছ পেয়ে খুশিতে চেঁচাচ্ছিল। মৎস্যশিকারি সেই বালিকাই আজ বাড়ির কেয়ারটেকার নওশেরের বউ কিনা সন্দেহ জাগে। সন্দেহ প্রকাশ করতে সাহস হয় না, কারণ নওশেরের তিন সন্তানের মধ্যে বড় আরজুর বয়স বারো হবে। পিয়া বাড়িতে আশ্রিত পরিবারের কাউকে না চিনলেও, পিয়ার সব খবরই রাখে তারা। বুড়ির কোন ছেলের মেয়ে, কোথায় থাকে, কী করে, এমনকি পিয়ার এখনও বিয়ে না করার গোপন কারণটিও তাদের অজানা নয়। প্রবাসী মনিবকন্যাকে খাতিরযতত্ন করতে একপায়ে খাড়া সবাই। তার সম্পর্কে গ্রামবাসীকেও নিশ্চয় মেলা কথা বলেছে তারা। ফলে পিয়াকে দেখতে ছুটে আসে অনেকেই। পিয়াকে দেখতে ছোটবড় বাড়িতে আসে যারা, তারা অবশ্য দাদির খোঁজখবরও নেয়। দাদির খোঁজখবর নিতে এসে তারা পিয়াকে দেখে, নাকি পিয়াকে দেখতে এসে দাদির খোঁজখবর নেয়? তবে লোকজন দেখলে পিয়াকে খাতিরযত্ন করার তৎপরতাও যেন বেড়ে যায় নওশেরের পরিবারের।

নওশের গাছ থেকে একগুচ্ছ ডাব পেড়ে আনে। পিয়াকে দেখিয়ে বলে, আপনার জন্য পেড়ে আনলাম। যে কয়টা খাইতে পারেন খান।

নওশেরের বউ মুখকাটা কচি একটা ডাব এগিয়ে দেয়। পানি খাওয়ার জন্য নলটি হয়তো আগে থেকেই জোগাড় করা হয়েছে ফান্টাপেপসির দোকান থেকে।

দাদিকেও দাও। ডাবের পানি খায় না দাদি?

হামার হাতে তোমার দাদি কিছু খায় না। তাকে সেবা করার জন্যও গ্রামেও কতো মানুষ!

বিদেশে থাকা নাতনি আসতে না আসতেই তার কাছেও আমার বিরুদ্ধে নালিশ শুরু করলি। ভাগ ঝগড়ি মাগী, ছোটলোকের বাচ্চা আমার সামনে থেকে তফাতে থাক।

বউটি গম্ভীর মুখ নিয়ে বুড়ির দিকে না তাকিয়ে বলে, বাথরুমে পানি সাবান সব দেয়া আছে। হাতমুখ ধুইয়া নেন, আমি পিঠা করলাম, চা দিয়া খান।

নওশেরের বউ অদৃশ্য হওয়ার পরও তাকে উচিত কথা শোনাতে ছাড়ে না অচেনা পড়শি মহিলা। পিয়াকে শোনাতেই চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করে, ঝগড়ির বাচ্চা কইতেই তোর মান গেল! তোর ঝগড়ি গলার তেজ আশপাশ মানুষের কান গরম করে না?

পিয়া বুঝতে পারে, বাড়িতে আশ্রিতদের সঙ্গে দাদির সম্পর্কের মাঝে সমস্যা আছে। সেই সমস্যা ঢাকতেই হয়তো নওশেরের পরিবার তাকে বেশি বেশি খাতির দেখায়। আসল ব্যাপারটা পরে দাদির কাছে বিস্তারিত জানা যাবে। অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ চাপা দিতে পিয়া বলে, ও দাদি, তোমার ফোন কেথায়? ফোন করলে ধরো না কেন?

কিশোর আরজু সগর্বে জানায়, দাদি তো ফোন চালাতে পারে না, দাদির ফোন আমি চালাই। টাকা শেষ হইলেও রিফিল করে আনি। আমি কল রিসিভ করে দাদিকে দেই। আপনার কল কখন আসিছল?

আরজুর সমবয়সী আরেক কিশোর অভিযোগ জানায়, আপনার দাদির ফোন নিয়া নিজের ফোনের মতো ফোটানি দেখায় আরজু। দাদি কিছু কয় না।

পিয়াও এরই মধ্যে বুঝে গেছে, আরজুর প্রতি বিশেষ নির্ভরতা ও পক্ষপাত থাকলেও তার বাবামায়ের উপর দাদির অসন্তোষ প্রবল। এক বাড়িতে থাকলেও ওদের এড়িয়ে চলতে চায়। ওরা ছাড়াও অবশ্য দাদির ফাইফরমাশ খাটার লোকের অভাব নেই। দাদিকে দেখতে এসে কথাবার্তা বলে সঙ্গ দেয়, আবার দাদির টুকটাক কাজ করে দেয় অনেকে। দাদির পিষা সুপারি খাওয়া অভাস, লোহার হামন-দিস্তায় সুপারি পেষার কাজ করে দেয় পড়শি একটি মেয়ে। গোসলের জন্য গরম পানিও করে দেয় এক মহিলা। জার্মানিতে দেখা সেই নির্জন বাড়ির একমাত্র বাসিন্দা কবরযাত্রী বুড়িকে সঙ্গ দেয়ার জন্য পোষা কুকুরটি ছাড়া কেউ ছিল না। ফোন পেলেই সোসাল সার্ভিসের লোকজন ছুটে আসত। কিন্তু দেশগ্রামে জনসংখ্যা বেশি বলেই হয়তো দাদির একাকিত্বটা চোখে পড়ে না তেমন।

ঘর ফাঁকা হলে পিয়া জানতে চায়, আরজুর বাপমা তোমাকে ঠিকমতো দেখেশোনা সেবাযত্ন করে না কেন?

দাদি জবাব দেয়, বড় হিংসুটি মেয়ে নওশেরের বউ। শুধু দিন গোনে, কোনদিন আমি মরে যাব। তারপর গোটা বাড়ি সংসার স্বাধীনভাবে ভোগ করবে। তোর বাপচাচারা তো কেউ এই ভিটায় আসবে না, আমার স্বামী শ্বশুরের ভিটাসম্পত্তি শয়তানদের ভোগদখলে যাবে।

এ বাড়ির ভবিষৎ নিয়া চিন্তা করার দরকার কি। তুমি সবার সেবা নিয়ে, তোমার প্রয়োজন মিটিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করবে।

শয়তানের মাঝে কতক্ষণ ভালো থাকা যায়! সেবা কি এমনি এমনি কেউ করে রে পিয়া? গ্রামে এখন টাকা দিয়াও কাজের লোক পাওয়া যায় না। গ্রামের মানুষকেও ঘুষ দিয়া কাম করাইতে হয়।

নওশের চাচারা সবাই তোমার সেবা করতে বাধ্য দাদি। আমি বলে দেব।

আলাদাভাবে নওশেরের পরিবারের কাছে দাদির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তারা পাল্টা অভিযোগ জানায়। বয়স হয়েছে তার, মতিগতি ঠিক থাকে না। কথায় কথায় নওশের ও তার পরিবারকে কুত্তা-বিলাইয়ের মতো বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়। ছেলেমেয়েরা সবাই মায়ের জন্য টাকা পাঠায়, তার উপরে প্রতি মওসুমে আবাদ থেকে যত ধান আসে, তার সবাই দাদি গাঁয়ের শয়তানদের মাঝে বিলিয়ে দিতে চায়। তার পাশে সারাদিন যারা ঘুরঘুর করে, ফালতু দরদ দেখায়, মেলা কিছু খসানোর মতলব নিয়াই এ বাড়িতে আসে তারা। বাধা দেয় বলে নওশেরের পরিবার চোখের বিষ, আর মতলববাজরা হইছে আপনজন।

পিয়া পরামর্শ দেয়, দাদির তো এখন শেষ সময়। মানুষকে দানখয়রাত করে যদি ভালেঅ থাকে, আপানারা বাধা দেবেন না। বরং তার মন রক্ষা করে চলার চেষ্টা করেন, আপনাদের জন্যও নিশ্চয় সে করবে। আমি ঢাকা গিয়ে বাবাকে বলব।

নওশের বলে, আমি মোবাইলে ওনাদের হুকুম নিয়াই সব করি। আমরা না থাকলে কি বড় আম্মা একলা এই বাড়ি-সম্পত্তি রক্ষা করতে পারত? বিদেশে থাকেন তো তাই জানেন না। এ জায়গার মানুষের মতো শয়তান আর হিংসাচোদা মানুষ আল্লার দুনিয়ায় আর নাই।

পিয়া ভাবে, গ্রামীণ সমাজে পারস্পরিক চেনাজানা ও মেলামেশার নেপথ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতিযোগিতা ও স্বার্থের টানাপোড়েন যেভাবেই কাজ করুক, শহরে ছেলেমেয়ের সংসারে থাকার চেয়ে একদিক থেকে ভালই আছে দাদি। একা হলেও স্বাধীন সে। মনে চাপা হিংসা-ক্ষোভ নিয়েও আরজুর মা বুড়ির দেখভাল করতে বাধ্য। শহরে ছেলের বাসায় থাকলে পুত্রবধূরা এটুকুও করত না। তাদের সময় নেই, পুরো সংসারের কাজকম চলে কাজের মেয়েদের উপর নির্ভর করে। গাঁয়ের গরিব ঘরের বউঝিরা সময় পেলেই দাদির খোঁজ নিতে আসে। দাদির ফাইফরমাশ খাটার মূলে তাদের ছোটখাটো ধান্ধা থাকে হয়তো, তবে আন্তরিকতা ও দরদটাও মিছে নয়। প্রয়োজন থাক বা না থাক, প্রতিমাসে নিয়মিত দাদির জন্য নগদ টাকা পাঠাতে বলবে বাবাকে। দুদিনের জন্য গ্রামে এসে দাদির জন্য আর কীইবা করার আছে পিয়ার। নিজের ট্যাব চালিয়ে ইন্টারনেটের জালে মুখ লকায় সে।

বিকেলে বাড়ির আঙিনা পর্যন্ত মোটর সাইকেল দাবড়ে আসে একটি যুবক। অচেনা যুবক যে পিয়াকে দেখতেই এসেছে, বুঝতে দেরি হয় না পিয়ার। মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে সে আগে দাদিকে খোঁজে, দাদির কাছে এসে তার কুশলাদি জিজ্ঞেস করে। দাদি পরিচয় করিয়ে দেয়, আজাদ মাস্টারের ছেলে বক্কর, রাজশাহী বিশ্ববিদালয় থেকে এমএতে ফাস্ট ক্লাস। কলেজের প্রফেসর, আবার তোর বাপের মতো মস্ত সরকারি চাকরিও পাইছে। ঢাকায় থাকবে।

দাদি ফোনে পিয়ার বিয়ে প্রসঙ্গে নিজেও বর দেখবে বলেছিল, এ ছেলে কি সেই বর? লাজুক যুবকটিও দাদির উচ্ছ্বাস থামাতে চায় যেন। লোকাল প্রাইভেট কলেজের লেকচারার সে। তবে বিসিএস দিয়ে রিটেন ও ভাইভাতে ভালভাবে টিকেছে, পুলিশ ভ্যারিভিকেশন আর মেডিকেল হয়ে গেলে জয়েন করবে। ঢাকায় পিয়াদের বাসাতেও তিনবার গেছে বক্কর। পিয়া বিদেশে থাকায় দেখা হয়নি। পিয়ার বাবা বিসিএস-এর ভাইভায় বক্করের জন্য তার এক বন্ধুকে সুপারিশ করেছিল।

গ্রামেও পিয়ার বর দেখার বিষয়টি মোটেও ঠাট্টা-মস্করার বিষয় ছিল না, সেটা বোঝাতে দাদি আর বিয়ে প্রসঙ্গে ইশারাও করে না। যুবকটিকে হুকুম দেয়, তোর বাপকে বলেছিলাম পিয়া আসলে তোদের বাড়িতে পাঠাব। তুই পিয়াকে নিয়ে যা বক্কর, বাপদাদার গ্রামখান একটু ঘুরে দেখুক। সেই ছোটবেলা একবার এসেছিল, কিছুই মনে নাই।

পিয়া বরং ঠাট্টার ভঙ্গিতে প্রসঙ্গটি তুলতে চায়, ও দাদি, তুমি না পালকিতে চড়ে প্রথম শ্বশুরবাড়ি এসেছিলে। আজ আমাকে মোটর সাইকেলে চড়ে কার বাড়িতে পাঠাচ্ছ? মানে সম্পর্কে এরা কী হবে, এনার ওয়াইফকে আমি কী ডাকব?

বক্করের দাদা তোর দাদাকে আপন বড় ভাইয়ের মতো মানত, আমাকে ভাবি ডাকত। বক্করের বাবামাকে তুইও চাচাচাচি ডাকবি।

সম্পর্ক হবে না জেনেও দাদির নির্বাচিত সম্ভ্যাব্য বরের শরীর ঘেঁষে তার মোটর সাইকেলে বসে গ্রামে ঘোরার কথা ভেবে পিয়ার মনে যেটুকু রোমাঞ্চ জাগে, তাকে দ্বিধা ভেবেই হয়তো বক্কর জবাব দেয়, হেঁটে গেলে আমাদের বাড়িতে যেতে দশ-পনেরো মিনিটের বেশি লাগবে না। আপনি তৈরি হোন, আমি মোটর সাইকেলটা রেখে আসছি।

বক্কর যাওয়ার পর দাদির প্রস্তাবের সমর্থন দিয়ে নওশেরের বউও পিয়াকে বলে, বক্করের বিয়া হয় নাই। এমন ভালো ছেলে গ্রামে আর একটাও নাই। দিনেরাইতে লেখাপড়া ছাড়া কোনো বদ নেশা নাই তার। পাঁচওক্ত নামাজ পড়ে। মাস্টারের একটাই ছেলে, ষয়-সম্পত্তিও আল্লা দেয় মেলাই আছে।

পিয়া হাতের ট্যাবে ক্ষীপ্র আঙুল চালিয়ে জবাব দেয়, আমার বর আমি ঠিক করব। আপনাদের চিন্তা করতে হবে না চাচি।

আধা ঘণ্টার মধে ফিরে আসে বক্কর। পিয়াকে স্বাগত জানাতে এরই মধ্যে বাড়িতে হয়তো বাবামাকে প্রস্তুত করে এসেছে, কিন্তু পিয়া বিশেষভাবে প্রস্তুত হওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। পরনে জিন্সের প্যান্ট নীল টিশার্ট ছিল, পোশাক না পাল্টে হাতের ফোন হাতে নিয়েই বলে, চলুন, আপনার বাড়ি যাওয়ার আগে পশ্চিমে বিলের দিকটায় একটু ঘুরে যাই।

হ্যাঁ, ওদিক দিয়েও যাওয়া যাবে আমাদের বাড়ি। চলুন।

প্রান্তরের মাঝখানের মেঠো পথ ধরে হাঁটার সময় বক্করই কথা বলে প্রথম, কেমন লাগছে আমাদের গ্রাম?

ধানক্ষেত ছাড়া এখানে দেখার আর কী আছে?

দেখার মতো টুরিস্ট স্পট এদিকে অবশ্য তেমন নেই। বিলটাও তো শুকিয়ে গেছে, ধান লাগিয়েছে লোকজন।

জার্মানিতে নাগরসীমার বাইরেও দেখা অসম্ভব সুন্দর ভূপ্রাকৃতিক দৃশ্য ও বিরল জনবসতির গ্রাম এলাকার স্মৃতি মনে পড়ে। পিএইচডির পর একটা ভালো চাকরি ও পার্মানেন্ট রেসিডিন্সি পারমিট পেলে দেশে ফেরার বদলে ইউরোপের গড্ডগ্রামেও সেটেল্ড হওয়াটাকে সৌভাগ্য ভাববে পিয়া। প্রবাসজীবনে একা লাগলে দেশের টান সে অনুভব করে ঠিকই, পরিবার ও স্বজনদের কথাও মনে পড়ে, কিন্তু তার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন-পরিকল্পনার মধ্যে এমন দেশগ্রামের ছায়া একটুও ছিল না।

আপনার ভালো লাগে এই গ্রাম?

জন্মভূমির প্রতি নাড়ির টান তো সবার থাকেই। আমাদের গ্রামেও এখন শহরের সব সুবিধা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো, এমনকি ইন্টারনেটও সহজলভ্য।

বিসিএস-এ জয়েন করে বউকে কি গ্রামে বাবামায়ের কাছে রাখবেন?

সরকারি চাকরিতে জয়েন করার পর পোস্টিং কোথায় হবে জানি না। তবে আমি ঢাকাতেই থাকার চেষ্টা করব। আর দাদি আপনাকে বলেনি বোধহয়, আমি কিন্তু এখনো সিংগেল। বিয়ের জন্য বাড়িতে অবশ্য সবাই উঠে পড়ে লেগেছে, মেয়ে দেখাদেখিও চলছে।

আপনার পছন্দের কেউ নাই? ইউনিভার্সিটিতে নিশ্চয় একাধিক বান্ধবী প্রেমিকা ছিল।

আমি আসলে লেখাপড়া আর ক্যারিয়ারের স্বপ্নপ্রেম নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলাম। এখন ফেইসবুকে ইউনিভার্সিটির কিছু বন্ধুবান্ধবীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হয় অবশ্য। আচ্ছা, আপনার ফেইসবুক আইডি কী নামে? একটা রিকোয়েস্ট পাঠাব?

মাথা নেড়ে নীরব সম্মতি দিলেও, ফেইসবুকের অসীম শূন্যতায় বক্করের সঙ্গে সম্ভাব্য ঘনিষ্ঠতা কোনো রোমাঞ্চ জাগায় না পিয়ার। তার বরং ইচ্ছে করে, এই নির্জন প্রান্তরে এখনই যুবকের হাত ধরে হাঁটে, নিরিবিলি কোথাও ঘনিষ্ঠ বসে চোখে চোখ রেখে পরস্পরকে জানার চেষ্টা করে। প্রস্তাবটা মুখেও দেয় সে, ধানক্ষেতের এই সবুজ দিগন্ত খুব ভালো লাগছে আমার। চলুন সবুজ সমুদ্রে ডুব মেরে কোথাও বসে কথা বলি।

বক্কর পিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে দ্বিধার সঙ্গে জবাব দেয়, গ্রামের লোক দেখলে কী ভাববে? ওই যে দেখেন একজন আসছে।

জমিতে সার ছিটানোর জন্য একটা বড় গামলা ভরা ইউরিয়া সার নিয়ে হনহন করে হাঁটছিল লোকটা। পিয়াকেও চিনতে পারার আনন্দে হাসিমুখে কথা বলে, আমি আরো মনে করলাম প্রফেসারের কোনো ছাত্রী বোধহয়। বাপদাদার ভিটা দেখতে বিদেশ হইতে আইলেন। যান, মাস্টারের বাড়িও একটু বেড়ায় আসেন।

কতদূরে আপনাদের বাড়ি?

এই তো এসে গেছি প্রায়।

একটা মোটা আলপথ ধরে কিছুটা হাঁটলে ডানদিকে কয়েকটা বাড়ি। কৌতূহলী কিছু ছেলেমেয়ের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি উপেক্ষা করে, একটা বাড়ির সামন দিয়ে হাঁটার সময় লাউড স্পিকারে আযানের ধ্বনি ভেসে আসে। আশেপাশে মসজিদ চোখে পড়ে না, টুপি মাথায় এক বুড়ো বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে।

মাইকের প্রবল শব্দপ্রপাতের মাঝেও পিয়াকে শোনাতে কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয়ে বলে বক্কর, আমাদের দেশে আযানের সময় মেয়েরা মাথায় ঘোমটা তুলে দেয় কিন্তু। কলেজেও মেয়েরা ওড়না মাথায় তোলে। আপনার তো ওড়নাও নেই দেখছি। আমার বাবা-মা কিন্তু বেশ ধার্মিক, দুজনেই হজ করে এসেছে এবার। ওই যে আমাদের বাড়ি।

পিয়া হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। বক্করের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে সিদ্ধান্ত নেয়, এই পোশাকে আপনাদের বাড়িতে যাওয়া ঠিক হবে না। পরে শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়েই না হয় আসব একদিন। আপনি যান, নামাজও পড়বেন নিশ্চয়। আমি ওদিকটা ঘুরে একাই বাড়ি ফিরতে পারব।

বক্করকে অবাক করে দিয়ে পিয়া উল্টোমুখ হয়ে হাঁটতে থাকে। বক্কর জানতে চায়, একা যেতে পারবেন? আমি আসি সঙ্গে।

পিয়া আর পিছনে ফিরে তাকায় না। মাথা নেড়ে প্রবল অসম্মতি জানায়।

বাড়িতে ফিরে দেখে দাদি জায়নামাজে বসে তসবি টিপছে। দিনেরাতে অনেকটা সময় জায়নামাজেই কাটে তার। জায়নামাজে একা হয়েও মানুষ আসলে একা থাকে না বোধহয়, একান্ত কাছে সর্বশক্তিমানের অস্তিত্ব তাকে সঙ্গ দেয়। এ সময় দাদিরও একাকিত্বের কষ্ট অন্তত থাকে না। কিন্তু পিতৃভূমিতে এসেও পিয়া আগন্তুক, নিজেকে আজ বড় একা মনে হয় তার। বিদেশেও অসীম শূন্যতায় নিঃসঙ্গ পাখি কিংবা সুতাকাটা ঘুড়ির মতো নিজেকে ভাসমান একা লাগত অনেক সময়। শেষ পর্যন্ত কোথায় যে স্থায়ী ও নিরাপদ ঠাঁই হবে, বুঝতে না পারায় অস্থির লাগত। এখনো সেরকম লাগছে। আবারও ট্যাব চালু করে ইন্টারনেটে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব পেইজটি বের করে সে। সেখান থাকে নিজের ডর্মিটরি ভবনের ছবিটি বের করে তাকিয়ে থাকে। অবশ্য নিজের প্রবাসজীবনের বহু স্মরণীয় মুহূর্তের ছবি ট্যাবের ডিজিটাল স্টোরে জমা আছে, ফেইসবুকেও পোস্ট করেছে অনেকগুলি। দেখে বন্ধুরা মুগ্ধ হয়েছে, লাইক দিয়েছে। কিন্তু ইন্টারনেটের সীমাহীন দিগন্তে হারিয়ে নিজের একাকিত্ব ও ঔদাসীন্য আর বাড়াতে চায় না পিয়া।

জানামাজ থেকে উঠে পিয়াকে ঘরে আবার মোবাইল খেলায় মগ্ন দেখে চমকে ওঠে দাদি, কখন আসলি তুই! বক্কর কই?

আমি বক্করের সঙ্গে তাদের বাড়িতে যাইনি দাদি। খারাপ লাগছিল। একা একা ঘুরে চলে এসেছি।

কী হইল তোর? মাস্টারের বউ কতো কি খাবার করি রাখছে তোর জন্য।

কী হবে গিয়ে। কাল ঢাকা চলে যাব। আর এক সপ্তাহ পর ফ্লাইট।

একা আর কতদিন থাকবি পিয়া? বয়স তো আর কম হইল না। তোর বয়সীরা দুই তিন বাচ্চার মা হইছে, কবে সংসার করবি তুই?

আমার মনে হয় সংসার হবে না দাদি।

দাদি নাতনির মাথায় হাত রেখে বলে, মাটি হইতে রস না পেলে গাছ বাঁচে না। মানুষও তেমনি রে পিয়া, সংসারে আপনজনদের মায়ামমতার মধ্যে না থাকলে একা যত লেখাপড় কর, যাত টাকাই কামাও, সুখেশান্তি পাবি না।

পিয়া বলে, তুমিও তো ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনিদের কাছ থেকে দূরে আছো, একা আছো। একা থেকেও তো ভালোই আছো মনে হচ্ছে।

দাদি বলে, তোর দাদা এই বাড়িসম্পত্তি রাখি ভিটায় কবরে শুইয়া আছে। ছেলেমেয়েরা সবাই সময় পাইলেই আমাকে দেখতে আসে। ফোনেও মা ডাক দেয়। কে কোনদিন বাড়ি আসবে, সেই আশায় দিন গুনি। তুই আসবি শুনিয়া রাস্তার দিকে তাকায় ছিলাম। আইজো নামাজে বসিয়া দোয়া করলাম তোর জন্য। আপনজনরা পাশে না থাকলেও গ্রামবাসী দেখতে আসে আমাকে। কিন্তু বিদেশে একা থাকিস তুই, কিছু একটা হইলে কে দেখবে তোকে?

দাদির স্নেহসুধা অন্তরকেও আপ্লুত করে আজ। কান্না পায় পিয়ার। উঠে দাঁড়িয়ে দাদিকে জড়িয়ে ধরে কান্নার গলায় কথা বলে, ঠিক বলেছো দাদি, আমি আসলে তোমার চাইতেও একা। তোমার তবু জায়নামাজের আশ্রয় আছে, আমার যে তাও নাই। রস পাওয়ার মতো তোমার এই বাড়িভিটা আছে, আমার যে তাও নাই দাদি। কতদিন একলা উড়ে বেড়াতে হবে জানি না।

পিয়াকে খুঁজতে ঘরে এসে থমকে দাঁড়ায় নওশেরের বউ। দুই অসমবয়সী নারীর মিলন যে আবেগয়ময় দৃশ্যের অবতারণা করেছে, তাতে ব্যঘাত না ঘটাতে দরজার আড়ালে লুকায় বউটি এবং কান পেতে পিয়ার কান্নার মানেও বোঝার চেষ্টা করে

প্রকাশ :জুন ৯, ২০১৭ ২:০৭ অপরাহ্ণ