দেশজনতা অনলাইন : ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস ইজিপ্টি মশার সম্ভাব্য বহু প্রজননস্থলে মশা নিধনে কোনো উদ্যোগ এখনো চোখে পড়েনি। ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তারের মধ্যে মশা নিধনে তোড়জোড়ের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এমন বহু জায়গা রয়ে গেছে, যেখানে মশার লার্ভা খালি চোখেই দেখা যায়।
এডিস মশার জীবনাচরণ বলছে, এই জাতের মশাগুলো মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। সিংহভাগ ক্ষেত্রেই মানুষের বাসা বাড়ি বা পাশেপাশেই ডিম পারে তারা। তবে রাস্তার পাশে এমন বহু স্থান রয়ে গেছে, যেগুলোও এডিসের পছন্দের জায়গা হতে পারে বলে জানাচ্ছেন একজন বিশেষজ্ঞ। তিনি ঘরের সম্ভাব্য প্রজননস্থল ধ্বংসের পাশাপাশি সেগুলোতেও ওষুধ ছিটানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
রাজধানীর গাবতলী থেকে বাবুবাজার পর্যন্ত বেড়িবাঁধ সড়কের দুই পাশে দেখা যাবে মশার বহু প্রজনন স্থল। সেখানে আছে পুরনো টায়ারের অর্ধশতাধিক দোকান। বিপুল পরিত্যক্ত টায়ার একসঙ্গে রেখে ফেলে রাখা হয়েছে আগোছালোভাবে। বৃষ্টির পানি জমে আছে বেশিরভাগে।
ডেঙ্গুর বাহক এডিস ইজিপ্টি মশা যেসব জায়গায় জন্ম দিতে পারে, তার একটি হলো পরিত্যক্ত টায়ার। সরকার ও নগর কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের এই বিষয়টি নিয়ে সতর্ক করতে নানাভাবে বার্তা ছড়াচ্ছে। বলা হচ্ছে, কেউ যেন পরিত্যক্ত টায়ার এখানে সেখানে ফেলে না রাখেন। কিন্তু পরিত্যক্ত টায়ারের দোকানিদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো ভাবান্তর আছে বলে মনেই হলো না।
গতকাল ওই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পড়ে থাকা টায়ারে বেশ দিনের পুরনো পানি জমে আছে। আর এই পানিতে মশার লার্ভা থাকার বিষয়টি খালি চোখেই দেখা যায়। শুক্রবার বলে দোকানগুলো বন্ধ। কর্মীদেরকেও পাওয়া যায়নি। একটি দোকানে থাকা মোবাইল নম্বরে কল করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
আশপাশের লোকজন জানালেন, ওই এলাকায় মশার প্রকোপ ব্যাপক। কিন্তু সর্বশেষ কবে ওষুধ ছিটানো হয়েছে, সে বিষয়ে কেউ জানাতে পারেননি।
বেড়িবাঁধ চাঁদ উদ্যান এলাকার বাসিন্দা মোতালেব হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের এইখানে এখনো কোনো মশার ওষুধ দেয় নাই। যারা ওষুধ দেয়, এখন পর্যন্ত তাগো কাউরে দেখি নাই।’
একই তথ্য জানিয়েছেন বেড়িবাঁধ এলাকার চায়ের দোকানদার মরিয়ম বেগম। বলেন, ‘সন্ধ্যার পর মশার যন্ত্রণায় দোকানে বসা যায় না। কাস্টমারও বসতে পারে না, আমিও বসতে পারি না। কিন্তু এখনো কেউ মশার ওষুধ দিতে আইল না।’
বেড়িবাঁধ তিন রাস্তার মোড়ে রজনীগন্ধা বাসস্টান্ডের সঙ্গেই রাখা আছে বিপুল ঢালাইয়ের মেশিন। এসব মেশিন প্রতিদিন ব্যবহার হয় না। মেশিনের উপরিভাগ খোলা থাকায় তার ভেতরে জমছে বৃষ্টির পানি। এই পানিতেও মশার লার্ভা দেখা যায়। জমে থাকা পানিতে এডিস মশার জন্ম হতে পারে, সেটা বলছে নগর কর্তৃপক্ষের বিলানো লিফলেটে।
স্থানীয় বাসিন্দা দিদাদুল ইসলাম সোহেল বলেন, ‘আমি প্রতিদিন এখান দিয়ে যাই আসি। সব সময় দেখি এখানে মেশিনগুলো দাঁড় করানো থাকে। এর মধ্যে পানি যেহেতু আছে, তার মানে এখানে মশায় হয়। আর ডেঙ্গু মশা তো পরিষ্কার পানিতেই হয়। এগুলা পরিষ্কার করা তো দরকার।’
মশা জন্মের স্থান পাওয়া গেছে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে। ইন্টারনেট কোম্পানিরগুলো এসব খুঁটিতে স্থাপন করে তাদের ইন্টারনেট সংযোগের বাক্স। রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই এমন চিত্র দেখা গেছে। খুঁটিতে বসানো এসব বক্সের নিচের অংশে বৃষ্টির পানি বের হয়ে যাওয়ার ছিদ্র থাকলেও তা খুব একটা কাজে আসে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বসানো এসব বাক্স পুরোপুরি সোজা রাখার সুযোগ নেই। ফলে এর মধ্যে বৃষ্টির পানি ঢুকলে তা বাক্সের এক পাশে জমে থাকে। তবে রোদের তাপে সে পানি শুকিয়েও যায়।
এ রকম আরও নানা ধরনের মশার আস্তানা চোখে পড়ে এই শহরে। এর মধ্যে এডিসের প্রজননস্থল হতে পারে জমে থাকা পরিষ্কার পানিগুলো।
বৃষ্টিতে এসব বক্সে জমা পানিতে এডিস মশা জন্ম নেয়াটা অসম্ভব নয় বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ঘরের ভেতর, ছাদ বা বাড়ির আঙ্গিনা ছাড়াও বাইরের নানা স্থানেও এডিস মশার জন্ম হতে পারে। কিন্তু এসব জায়গা নজর এড়িয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দেশের আবহাওয়া ডেঙ্গু মশার জন্য অত্যন্ত উপযোগী আবহাওয়া। সে যেখানে ডিম পাড়ে, কিংবা বংশ বিস্তার করে, সেই জায়গাটা যদি আমরা তার জন্য অনুপযোগী করে দিতে পারি তাহলে তাকে আটকানো সম্ভব।’
‘এমন কিছু কমন প্লেস আছে যা আমাদের নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। ছাত্রাবাস, বাসার ছাদ, পথের পাশের চায়ের দোকান, ডাবের খোসা, গাড়ির টায়ার, ফেলে রাখা জিনিসপত্র এমন অনেক জায়গা আছে যা আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি। এসব জায়গার দায়িত্ব অনেকে নিতে চায় না। এসব জায়গা বাদ দিলে এডিস দমন করা যাবে না। এডিস জন্ম নেবে। সেখান থেকে এডাল্টটিসাইড মশা উড়ে অন্যত্র চলে যাবে এবং আমাদের আক্রান্ত করবে। সাত থেকে ১৫ দিনের মধ্যে তারা আবার সক্রিয় হয়ে উঠবে।’
বাংলাদেশে এডিস এই প্রথম নয়। এর আগেও দেশে ডেঙ্গু দেখা গেছে। আগামীতেও যে দেশে এর প্রাদুর্ভাব দেখা যাবে না, তাও নিশ্চিত নয় বলে জানানেন এই বিশেষজ্ঞ। এ জন্য এডিস দমনে সর্বোচ্চ সতর্ক হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে এডিস মশার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে বলে মনে করেন এই কীটতত্ত্ববিদ।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মুমিনুর রহমান মামুনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এসএমএস পাঠাতে বলেন। বিষয়টি নিয়ে এসএমএস দিলেও তিনি কোনো জবাব পাঠাননি।
আরেক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ইমদাদুল হকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।