দেশজনতা অনলাইন : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ও গুগল সরকারকে ভ্যাট দেওয়ার জন্য ‘ভ্যাট এজেন্ট’ নিয়োগ দিতে পারবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাট নিবন্ধনও নিতে পারবে। যদি এই প্রক্রিয়ায় কোনও অসঙ্গতি থাকে, তাহলে ফাঁকিবাজকে চিহ্নিত করা হবে আইটি ফরেনসিক ল্যাবের মাধ্যমে। এছাড়া, মনিটরিংয়ের মাধ্যমেও কারা এই খাতে কাজ করছে, তা চিহ্নিত করে ভ্যাট আদায়ের উদ্যোগ নেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
তারা বলছেন, অফিস চালু না করলে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ও গুগল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করা বেশ জটিল। তবে শুরু হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বিষয়টিকে ইতিবাচক অর্থেই দেখছেন। ভ্যাট এজেন্ট নিয়োগ বিষয়টিকে সহজ করবে বলে তারা মনে করেন।
গুগল-ফেসবুক-ইউটিউব হাজার কোটি টাকা এ দেশ থেকে নিয়ে গেলেও সরকারকে কোনও কর দেয় না। এ দেশে নিবন্ধিত না হওয়ায় বা কোনও অফিস না থাকায়, তাদের করের আওতায় আনতে পারেনি সরকার। বৈধ চ্যানেল না থাকার কারণে ঠিক কী পরিমাণ অর্থ প্রতিবছর দেশের বাইরে চলে যায়, তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যানও পাওয়া যায় না সরকার, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এমনকি তথ্যপ্রযুক্তি সংগঠনগুলোর কাছেও। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, বিজ্ঞাপন খাত ও বুস্টিংয়ের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার বেশি দেশের বাইরে চলে যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মিফতাহ উদ্দিন খান বলেন, ‘আমাদের ফরেনসিক ল্যাবরেটরি আছে। যুক্তরাজ্য সরকারের উন্নয়ন সংস্থা ডিএফআইডি সেই ল্যাব বছর পাঁচেক আগে তৈরি করে দিয়েছে। আমাদের অনেক কর্মকর্তা এই ল্যাব পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। ফলে আমরা এখন এই ল্যাব পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত। আমরা গুগল, ফেসবুক, ইউটিউবসহ এ জাতীয় সব মাধ্যমকে মনিটর এবং ট্র্যাক করতে পারবো। কোথায় কী হচ্ছে, কী লেনদেন হচ্ছে, কোথায় বিজ্ঞাপন যাচ্ছে—তা বের করতে আমাদের এখন আর খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না।’
তিনি জানান, পাঁচ বছর আগে ডিএফআইডি এই ল্যাব প্রতিষ্ঠার পরে তা অব্যবহৃত ছিল। এতদিন ফরেনসিক ল্যাব কোনও কাজে না লাগলেও এখন তা কাজে লাগানো যাবে। তিনি উল্লেখ করেন, এসব সামাজিকমাধ্যম থেকে আয়ের বিষয়টিকে এখন আর ছাড় দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এই সদস্য আরও উল্লেখ করেন, এসব মাধ্যমে কারা কোথায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে, কত টাকার দিচ্ছে, কীভাবে দিচ্ছে, কাদের মাধ্যমে দিচ্ছে, কোথা থেকে দেওয়া হচ্ছে—তা আমরা চিহ্নিত করতে পারবো। ব্যাংকের মাধ্যমে সরাসরি বা ক্রেডিট কার্ডে দেওয়া হলেও সেই তথ্য এই ল্যাবের মাধ্যমে বের করা সম্ভব।
প্রসঙ্গত, এবারের বাজেটে (২০১৯-২০২০ অর্থবছরে) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ফেসবুক, ইউটিউব, গুগলসহ সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভ্যাট নিবন্ধনের নির্দেশ দিয়েছে। গত ২৬ জুন এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করেছে এনবিআর। সার্কুলারে বলা হয়, রাজস্ব সুরক্ষা ও রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে অনাবাসিক ব্যক্তি বাংলাদেশে প্রদত্ত বেতার, টেলিভিশন ও ইলেক্ট্রনিক সেবা (যেমন−ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, ভাইবার, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি মাধ্যম ব্যবহার করে প্রদত্ত মেসেজ, বিজ্ঞাপন ও অনুরূপ যেকোনও সেবা) সরবরাহকারী সব প্রতিষ্ঠানকে মূসক এজেন্ট নিয়োগ, মূসক নিবন্ধন গ্রহণ করতে লিখিতভাবে অনুরোধ করা হলো।
নতুন ‘মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন-২০১২’-এর ১৯ ধারা অনুযায়ী ফেসবুক, ইউটিউব, গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানকে মূসক নিবন্ধন নিতে হবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে অফিস স্থাপন অথবা মূসক এজেন্ট নিয়োগ দিতে হবে।
সামাজিক গণমাধ্যম বিষয়ক গবেষক ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান প্রেনিউর ল্যাবের প্রধান নির্বাহী আরিফ নিজামী বলেন, ‘ভ্যাট আরোপ করে যতটা পাওয়া যায়, ততটাই লাভজনক।’ তবে এভাবে কতটা আদায় করা যাবে, সে বিষয়টা সময়ের ওপরই ছেড়ে দেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যেগুলো হয়, সেসব হয়তো চিহ্নিত করা যাবে, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে যেগুলো হয়, সেগুলো তো ধরা কঠিন হবে। অনলাইনে বিশেষ করে ফেসবুকে ডলার কেনাবেচা হয়, ব্যবসা হচ্ছে (ফরেক্স ট্রেড)। এসব থেকে পেমেন্ট দেওয়া হলে তা চিহ্নিত করা যাবে না।’
আরিফ নিজামী এই বাজারকে গ্রে মার্কেট অভিহিত করে বলেন, ‘এই মার্কেট নিয়ন্ত্রিত নয়, অনিয়ন্ত্রিত। ফলে বিষয়টির নিয়ন্ত্রণ বেশ কঠিনই হবে।’
ভ্যাট এজেন্ট বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি যতদূর জানি, ভ্যাট এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া যায়। ভারতেও এমনটা আছে।’ এ প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞাপনদাতাদের খরচ বাড়বে, ফলে বিষয়টি নিয়ে আরও লুকোচরি হবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
নাম ও পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ডিজিটাল বিজ্ঞাপনী সংস্থার শীর্ষ নির্বাহী বলেন, আমরা গুগল, ফেসবুকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রকাশের ব্যবস্থা করি। বিনিময়ে কমিশন পেয়ে থাকি। চুক্তি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিল তৈরির সময় হয়তো এখন থেকে ভ্যাট যুক্ত করে বিল তৈরি করতে হবে। তবে তিনি এখনও নিশ্চিত নন, পুরো প্রক্রিয়াটি কীভাবে সম্পন্ন হবে। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, এখনও তিনি জানেন না গুগল, ফেসবুক, ইউটিউবের ভ্যাট কীভাবে ধরা হবে, জমা দিতে হবে কোথায়, কমিশনের ওপর কোনও ভ্যাট আরোপ করা হবে কিনা ইত্যাকার বিষয়।
এখন পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠান কোনও ভ্যাট এজেন্ট নিয়োগ করেনি বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এ দেশে এফএম কনসাল্টিং ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান ভ্যাট এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। তবে ফেসবুক, গুগল বা ইউটিউবের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাট এজেন্ট হিসেবে এফএম কনসাল্টিং ইন্টারন্যাশনাল বা অন্যকোনও প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছে বলে জানা যায়নি।