দেশজনতা অনলােইন : এক বছরে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের আমানতের পরিমাণ ২৯ শতাংশ বেড়েছে। অর্থ বাড়ার এই ঊর্ধ্বগামীর কারণ অনুসন্ধান এবং প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা নির্ধারণে তদন্তে নামছে সরকার।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশীদের অর্থ বাড়ার বিষয়টি পুরোপুরি নেতিবাচকভাবে দেখছে না সরকার। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সুইস ব্যাংকে টাকা বাড়ার বিষয়টি শুধু অর্থ পাচার নয়। এর মধ্যে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং প্রবাসীদের ডিপোজিটের বিষয়টিও জড়িত।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) প্রকাশিত ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে মুদ্রা পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে গঠিত বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এ বিষয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করেছে।
সংস্থাটি আগামীকাল রোববার থেকেই আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। এমনকি এ বিষয়ে রোববার বৈঠকও করতে যাচ্ছে এই ইন্টেলিজেন্স ইউনিট।
এ বিষয়ে বিএফআইইউ’র প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, সুইস ব্যাংকে বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কারণে অর্থ জমা রাখেন। তবে গত একবছরে বাংলাদেশিদের আমানতের পরিমাণ ১ হাজার ২৭৪ কোটি বাড়ার বিষয়টি সরকারের দৃষ্টিতে এসেছে। আমাদের ইউনিট কাল (রোববার) থেকে কাজ শুরু করবে।
তিনি বলেন, তবে ঢালাওভাবে পুরোপুরি বিষয়টিকে নেতিবাচক হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। কারণ বাংলাদেশীদের টাকা বৃদ্ধির এই বিষয়টি শুধু অর্থ পাচার নয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও লেনদেন বেড়েছে। এছাড়া ওখানে প্রবাসীরা ব্যাংকগুলোতে বিপুল পরিমাণ ডিপোজিট রাখছেন। এসব কারণে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে টাকা বৃদ্ধি পেতে পারে। এরপরও কেন টাকা বাড়ছে সে ব্যাপারে অনুসন্ধান চালানো হবে।
তিনি আরো বলেন, কেউ যদি টাকা সেখানে অবৈধভাবে নিয়ে থাকে, সেটা আমরা দেখবো। যেহেতু আমরা এগমন্ট গ্রুপের সদস্য সেহেতু আমরা প্রয়োজনে তাদের চিঠি লিখবো। এর আগেও তাদের কাছে বিভিন্ন ধরনের তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, এগমন্ট গ্রুপ হলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) সমন্বয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম, যারা মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়নসংক্রান্ত তথ্য নিয়ে কাজ করে।
‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের আমানতের পরিমাণ এখন ৫ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা বা ৬১৭ দশমিক ৭২ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ। এক বছরে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ১ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা বা ২৯ শতাংশ। আগের বছর আমানতের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৬৯ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬২ কোটি সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশী মুদ্রায় যা ৫ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। তবে ২০১৭ সালে ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৪ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। বাংলাদেশী মুদ্রায় এক সুইস ফ্রাঁর বিনিময়মূল্য এখন ৮৬ টাকা ৪৩ পয়সা। ২০১৬ সালের তুলনায় অবশ্য ২০১৭ সালে সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশীদের অর্থ জমার পরিমাণ কমে গিয়েছিল। সাধারণত সুইস ব্যাংক অর্থের উৎস গোপন রাখে।
তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের বছরেও সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমা করা অর্থের পরিমাণ বেড়েছিল। যেমন ২০১৩ সালে বিভিন্ন সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ছিল ৩৭ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৩ হাজার ২১৪ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৫১ কোটি সুইস ফ্রাঁ বা ৪ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা।
কোনো দেশের নাগরিকদের কত অর্থ জমা আছে তা প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করে ব্যাংকটি। তবে একক অ্যাকাউন্টের তথ্য প্রকাশ করা হয় না। সুইজারল্যান্ডে ব্যাংকের সংখ্যা ২৪৮টি। গ্রাহকের নাম-পরিচয় গোপন রাখতে কঠোর তারা।
ধারণা করা হয়, অবৈধ আয় ও কর ফাঁকি দিয়ে জমানো অর্থ এখানে রাখা হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই বরাবরই সুইস ব্যাংকে বিশ্বের ধনী এবং বিখ্যাত লোকেদের অর্থ জমা রাখার বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতুহল বেশি থাকে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, গ্রাহকের গোপনীয়তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সুইস ব্যাংকগুলোর সুনাম রয়েছে। কোন সুইস ব্যাংকে কে কত অর্থ জমা রেখেছে, সেই তথ্য সুইস ব্যাংক ফাঁস করে না। তাদের মতে, একজন ডাক্তার বা আইনজীবী যেভাবে তার রোগী বা মক্কেলের গোপনীয়তা বজায় রাখেন, এখানেও ব্যাপারটা সেরকম। একজন সুইস ব্যাংকার তার গ্রাহকের কোন তথ্য কাউকে দিতে বাধ্য নন, এটা রীতিমত নীতি এবং আইন বিরুদ্ধ। সুইস ব্যাংকে আমানত বাড়ার পেছনে এই কারনটি অন্যতম হিসেবে কাজ করে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, যাদের কাছে কালো টাকা রয়েছে তারা এদেশে ঘোষণা দিয়ে বিনিয়োগ করতে চায় না। ধারণা করা হয়, যিনি কালো টাকা বিনিয়োগ করবেন তিনি চিহ্নিত হয়ে থাকবেন। এ জাতীয় নিরাপত্তাজনিত ভাবনা থেকে সুইস ব্যাংকগুলোকে বেছে নিচ্ছেন তারা। পাশাপাশি বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনতেও অনেকে বিদেশে টাকা নিয়ে যান।