অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের আইনজীবীদের দাবি, মামলাগুলো হয়রানিমূলক ও অনেকাংশে রাজনৈতিক। ফলে এসব মামলা থেকে নিরপরাধ সাধারণ শিক্ষার্থীদের অব্যাহতি দেওয়া উচিত।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই জাবালে নূর পরিবহনের একাধিক বাস যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে একটি বাসের চাপায় বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। আহত হন আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী ও অপেক্ষমাণ যাত্রী। এ ঘটনার প্রতিবাদে ওইদিনই রাস্তায় নামে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। দুই শিক্ষার্থীকে বাসচাপায় ‘হত্যার’ বিচারসহ নিরাপদ সড়কের জন্য ৯ দফা দাবিতে চলে টানা আন্দোলন। স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে ৪ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সমর্থন দেন। ওই দিন সায়েন্স ল্যাব, জিগাতলা ও ধানমন্ডিতে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সময় গুজব রটানো হয় আওয়ামী লীগ অফিসে ৪ শিক্ষার্থীকে মারধর করে হত্যা, একজনের চোখ উপড়ানো এবং আরও চার ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এই গুজব শুনে শিক্ষার্থীরা আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে গেলে সেখানে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ ঘটে।
এ ঘটনার প্রতিবাদে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন চলার সময় পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। এসব ঘটনায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের পক্ষে নাশকতার মামলা দায়ের করা হয়। এরপরেই ধানমন্ডি, বনানী, বসুন্ধরা ও বনশ্রী এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে আন্দোলন চলার সময় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী পুলিশের হাতে আটক হন। আটকদের মধ্যে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শিক্ষার্থী ছিলেনও। আটকের পর ৬ আগস্ট বাড্ডা থানায় দায়ের করা মামলায় ১৪ শিক্ষার্থী ও ভাটারা থানার মামলায় ৮ জনকে আসামি করা হয়। তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে ১২ দিন কারাভোগের পর ঈদের আগে তারা জামিনে মুক্তি পান।
পরদিন (৭ আগস্ট) এই ২২ শিক্ষার্থীকে আদালতে হাজির করে দুই দিনের রিমান্ডে আনা হয়। রিমান্ডের পর কারাগারে পাঠান আদালত। তারাও ১২ দিনের কারাভোগ শেষে জামিন পান।
কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেলেও হয়রানি থেকে মু্ক্তি পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক।
এ প্রসঙ্গে ওই ঘটনায় বাড্ডা থানায় দায়ের করা মামলার আসামি, সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ইকতিদার হোসেন বলেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত ৯ বার আদালতে হাজিরা দিয়ে এসেছি। সর্বশেষ গত ২৭ মে হাজিরা দিয়েছি। ক্লাস পরীক্ষা রেখে হাজিরা দিতে সেই পুরান ঢাকা যেতে হয়। যাওয়া-আসায় দিন শেষ হয়ে যায়। সেদিন আর ক্লাস বা পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকে না। কোনও অপরাধ না করেও অপরাধীর মতো ঘুরছি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একই মামলার আসামি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের কেন গ্রেফতার করা হয়েছিল, আমাদের অপরাধটা কী, জানি না। যে অপরাধের কথা বলা হচ্ছে, এমন কিছু ঘটেনি বা ঘটে থাকলেও আমি এর ধারেকাছে ছিলাম না। কিন্তু আমাকে ধরে নিয়ে গেলো পুলিশ, রিমান্ডে আনলো। জেল খাটলাম। এখন জামিনে। হাজিরা দিয়ে যাচ্ছি দিনের পর দিন। আমি তো অপরাধ করিনি। আমাকে কেন হয়রানি করা হচ্ছে? আমার পরিবারকে কেন হয়রানি হতে হচ্ছে? এর জবাব কোথাও পাই না। কবে বন্ধ হবে, সেটাও জানি না।’
কবে মামলা নিষ্পত্তি হবে, সে তথ্য জানা নেই খোদ তদন্ত কর্মকর্তাদেরও। তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে বাড্ডা থানায় দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জুলহাস মিয়া ও ভাটারা থানার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই হাসান মাসুদ প্রায় একই তথ্য জানালেন। তদন্তে এই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তারা উভয়েই বলেন, ‘মামলার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে তা আদালতে জমা দেওয়া হবে।’
এদিকে, তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এখন পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারে ওপর মহল থেকে কোনও সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি।
তবে, তদন্তে কোনও নিরপরাধ শিক্ষার্থী যেন জড়িয়ে না যান, সে ব্যাপারে তদন্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) শেখ নাজমুল আলম। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বিষয়ে আমাদের অবস্থান শুরু থেকেই নমনীয় ছিল। আমরা চাই না, নিরপরাধ কেউ মামলায় জড়াক। ওই সময় দায়ের করা মামলাগুলোর তদন্ত চলছে। দ্রুত তদন্ত শেষে মামলা নিষ্পত্তি করা হবে।’
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন মামলায় আসামিদের মধ্যে অনেকের শিক্ষাজীবন শেষ হয়েছে। কিন্তু মামলা থাকায় কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন অভিভাবকরা।
এই ঘটনায় ভাটারা থানার মামলার আসামি ও সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী অনিকের বোন অনন্যা বলেন, ‘আমার ভাইসহ বেশ কয়েকজনের পড়াশোনা শেষ হয়েছে। কিন্তু তারা চাকরিতে যোগ দিতে পারছেন না মামলার কারণে। ভাইয়ের এই মামলার ঝামেলায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বাবা। আমরা চাইবো, অনিকসহ নিরপরাধ এই ভাইদের অচিরেই মামলা থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। সরকার এদিকে সজাগ দৃষ্টি দেবে। যেন কারও শিক্ষা ও কর্মজীবন ব্যাহত না হয়।’
শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার আইনজীবী হিসেবে লড়ছেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি পুলিশের তদন্ত দীর্ঘ সময়েও শেষ না হওয়ার প্রসঙ্গে বলেন, ‘আদালতে চার্জশিট যে সময়ের মধ্যে দেওয়ার কথা সেটা কখনোই ফলো করা হয় না। এটা পুরনো ট্রেন্ড। আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, এই মামলাগুলো হয়রানিমূলক মামলা। মামলা করে তাৎক্ষণিকভাবে হয়রানি করাই ছিল ওই সময়ের উদ্দেশ্য। অন্য কোনও অভিযোগ করার মতো কিছুই এই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ছিল না। তাদের নিরাপদ সড়কের দাবি ছিল যৌক্তিক। এ কারণেই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করতে দেরি হচ্ছে। গৎবাঁধা কিছু কথা বলা ছাড়া অভিযোগের বিষয়ে বলার মতো কিছু নেই।’
মামলাগুলো হয়রানিমূলক উল্লেখ করে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এই হয়রানিমূলক মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা হোক।’ মামলা থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়ারও আহ্বান জানান এই আইনজীবী।