কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। এর মধ্যে কু-ঋণ বা মন্দ ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে রাখতে হচ্ছে ৫০ শতাংশ এবং নিম্নমানের ঋণে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে ২০ শতাংশ হারে। এছাড়া নিয়মিত ঋণের বিপরীতেও প্রভিশন রাখতে হয় ১ শতাংশ হারে। মূলত, গ্রাহকের রাখা আমানতের সুরক্ষার জন্য ব্যাংকগুলোকে বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে বিভিন্ন হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮ সালে সম্পদের মান সবচেয়ে বেশি কমেছে সরকারি ব্যাংকগুলোতে। তাদের সামগ্রিক দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও কর্মদক্ষতার অভাবে সম্পদের মান খারাপ হয়েছে।
ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই খাতে দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও কর্মদক্ষতার অভাবে মানসম্পন্ন সম্পদের পরিমাণ কমেছে। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ব্যাংক খাতের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে ব্যাংকগুলোতে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে।’ খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার জন্য তিনি ব্যাংকের এমডিদের দুর্বলতাকে দায়ী করেন।
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরেই বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আদায় অযোগ্য কু-ঋণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে এই খাতে প্রভিশন রাখার পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। ২০১১ সালে প্রভিশন রাখতে হয়েছিল মাত্র ১৫ হাজার কোটি টাকা। ২০১৮ সালে প্রভিশন রাখার কথা ছিল ৫৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা। এরমধ্যে ব্যাংকগুলো ৫০ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা রাখতে পেরেছে। অর্থাৎ ব্যাংকের এই পরিমাণ অর্থ আটকে। অবশ্য এখনও প্রভিশন ঘাটতি আছে ৬ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। তবে, ঘাটতিতে থাকা ১৫ ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় নয় হাজার ৫২৩ কোটি টাকা কম রেখেছে। এরমধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানার চার ব্যাংকের ঘাটতি সাত হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। বেসরকারি ১১ ব্যাংকের ঘাটতি রয়েছে এক হাজার ৬৪০ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে গিয়ে নিট মুনাফা সাড়ে ৫৭ শতাংশ কমেছে। ২০১৮ সালে ব্যাংকগুলো নিট মুনাফা করে চার হাজার ৪০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে নিট মুনাফা ছিল ৯ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে নিট মুনাফা হয়েছিল আট হাজার ৩১০ কোটি টাকা এবং ২০১৫ সালে ব্যাংকগুলোর মুনাফা হয়েছিল সাত হাজার ৯২০ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, ব্যাংকগুলো প্রভিশন রাখে মূলত মুনাফার অর্থ অথবা মূলধনের অর্থ থেকে। এগুলোর বিপরীতে কোনও আয় হয় না ব্যাংকের। এগুলো ঋণ হিসাবেও বিতরণ করতে পারে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে যাচ্ছে উদ্বেগজনকভাবে। প্রতিবেদনে ২০০৭-০৮ সালের বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০০৭-০৮ সালে যে আর্থিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল, তার শুরুটা ছিল আমেরিকার ব্যাংকিং খাত থেকে। ওই দেশের ব্যাংকগুলো তখন বেপরোয়া গতিতে গৃহায়ন খাতে ঋণ দিলেও তার বিপরীতে যথেষ্ট জামানত ছিল না। জামানতের মান অত্যন্ত দুর্বল। একপর্যায়ে টাকা ফেরত আসছিল না। ব্যাংকগুলোও জামানত বিক্রি করে ঋণের টাকা আদায় করতে পারছিল না। তখন ব্যাংকিং খাতে সম্পদের মান খারাপ হতে থাকে। এতে বেড়ে যায় ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ। তখন পথে বসে ব্যাংকিং খাত। ওই সময়ে আমেরিকার অর্থনীতিতে ধস নেমেছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণ কম থাকলে ঋণের সুদের হার কমে যাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের হার কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া, সম্পদের ব্যবস্থাপনার মান ও দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য আমরা সবাই চেষ্টা করছি। সেক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারও চেষ্টা করছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘যেসব ব্যাংকের খেলাপি বেশি, তাদের প্রভিশন খাতে বেশি টাকা আটকা আছে। আর যাদের খেলাপির পরিমাণ ঋণ কম, তাদের প্রভিশন খাতে বেশি টাকা আটকা নেই, তারা চাহিদা অনুযায়ী ঋণও বিতরণ করছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, বেশ কিছু ব্যাংকের দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার কারণে ব্যাংকিং খাতে সার্বিক সম্পদের মান কমে গেলেও কিছু খাতে উন্নতিও হয়েছে। যেমন গ্রামে ব্যাংকিং খাতের প্রসার ঘটেছে। একইভাবে ইসলামী ব্যাংকিংয়েরও প্রসার ঘটছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নিট খেলাপি ঋণের হার বাংলাদেশে ২ দশমিক ২ শতাংশ। ভারতে নিট খেলাপি ঋণের হার সোয়া ৫ শতাংশ, ভুটানে ৫ শতাংশ, মালদ্বীপে আড়াই শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ২ শতাংশ ও মালয়েশিয়ায় ১ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, সম্ভাব্য খেলাপি হওয়া থেকে বিরত থাকতে এবং খেলাপি হওয়ার পর তা নিয়মিত করতে পুনঃতফসিলে ঝুঁকছেন ঋণগ্রহীতারা।
২০১৮ সালে ব্যাংকগুলোতে ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করা হয়েছে। যা তার আগের বছরের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি। এভাবে গত পাঁচ বছরে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাতে।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি পুনঃতফসিল করা হয়েছে। পুনঃতফসিল সুবিধার ৫৮ শতাংশই নিয়েছেন বড় বড় শিল্প উদ্যোক্তারা।