দেশজনতা অনলাইন : আস্থার সংকটে পড়েছে গণমাধ্যম। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে সংকটের সাতটি কারণ পাওয়া গেছে।তবে এ সংকট থেকে উত্তরণ অসম্ভব নয় বলে মনে করেন গণমাধ্যমকর্মী ও সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারা। তারা বলছেন, এ জন্য গণমাধ্যমকর্মী, সাংবাদিকদের সংগঠন ও মালিকপক্ষকে একযোগে কাজ করতে হবে। উত্তরণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকতে হবে সরকারকেও।
সংকটের সাত কারণ
১. রাজনৈতিক দলপ্রীতির কারণে সংবাদপত্র ও অনলাইন মিডিয়ার পাঠক এবং রেডিও ও টেলিভিশনের দর্শক-শ্রোতার আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা ক্ষুণ্ন হয়েছে।
২. রাজনৈতিক দল ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের চাপের পাশাপাশি পেশিশক্তি ও জঙ্গিদের ভয়ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ বা সম্প্রচারে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৩. আইনি বেড়াজালও পুরো সত্য প্রকাশে বাধা হচ্ছে।
৪. গণমাধ্যম মালিকদের পছন্দ-অপছন্দ প্রাধান্য পাওয়ায় পুরো সত্য সামনে আনতে পারছেন না গণমাধ্যমকর্মীরা।
৫. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইন মিডিয়ার বিপুল প্রসার ঘটেছে। এই মাধ্যমে সত্য, মিথ্যা ও গুজব মিলিয়ে নানা ধরনের সংবাদও আসছে। যা শুধু বিভ্রান্তিই তৈরি করছে না, মূলধারার গণমাধ্যমকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
৬. গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরির বিধি না থাকাও সংকটের অন্যতম কারণ। এবং
৭. ডিজিটাল মিডিয়ার কারণে বিজ্ঞাপনের বাজার সংকুচিত হওয়ায় আর্থিক বিপাকে পড়েছে গণমাধ্যম।
‘বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের বিকল্প নেই’
গণমাধ্যমকর্মীদের রাজনৈতিক দলের কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার কারণেই গণমাধ্যম আস্থার সংকটে পড়েছে বলে মনে করেন দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম। তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমকর্মীরা নিজেরাই নিজেদের মর্যাদার আসন ধরে রাখতে পারছেন না। অধিকাংশ গণমাধ্যমকর্মীই এখন রাজনৈতিক দলের কর্মীর মতো আচরণ করছেন। আমরা যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের বক্তব্য দেখি, সেলফ সেন্সরশিপ দেখতে পাই। মূল সংবাদটা যেভাবে প্রকাশ বা সম্প্রচার হওয়া দরকার সেটি প্রকাশিত হয় না। টেলিভিশনের দর্শক ও সংবাদপত্রের পাঠক প্রত্যাশা করেন যে ঘটনা ঘটবে তা টেলিভিশনে বা সংবাদপত্রে দেখতে পাবেন। কিন্তু আমরা গণমাধ্যমকর্মীরা সেটি পুরোপুরি তুলে ধরতে পারছি না এই মুহূর্তে।’
নঈম নিজম বলেন, ‘এমনিতেই সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইন মিডিয়া মূলধারার গণমাধ্যমের জন্য একটা বড় হুমকি। এই হুমকি মোকাবিলা করতে হলে অবশ্যই মূলধারার গণমাধ্যমকর্মীদের আন্তরিক হতে হবে, সততা ধরে রেখে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে হবে।’
অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সিনিয়র রিপোর্টার নুরুল ইসলাম হাসিবের মতে, গণমাধ্যমকর্মীরা পেশাদারিত্ব ধরে রাখতে পারছেন না বলেই আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের তথ্য আসে। আর এসব যাচাইবাছাই না করেই প্রচারিত হচ্ছে। মানুষ আসলে সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য মূলধারার গণমাধ্যমের আশ্রয় নেয়। মূলধারার গণমাধ্যমও যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মতো ভূমিকা রাখে তখন পাঠক বা দর্শক দোদুল্যমান অবস্থায় পড়ে। আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট তৈরি হয়।’
‘সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে গণমাধ্যম’
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সহ-সভাপতি সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘গণমাধ্যমের মূল কাজ হলো সত্য তুলে ধরা, সমাজের দর্পণ হিসেবে কাজ করা। সেটি হচ্ছে না।’ তার মতে, আস্থার সংকটে পড়া গণমাধ্যম এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে।
ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত সমাজ আমাদের, বিভাজন আরও বাড়ছে। সংসদ, প্রশাসন বা অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না। তারই একটা প্রতিফলন ঘটেছে গণমাধ্যমেও।’ এখন গণমাধ্যমকর্মীদের স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই, পুরোটাই মালিকদের স্বাধীনতা— এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘মালিকের কথার বাইরে কোনও গণমাধ্যম পরিচালিত হচ্ছে না। অন্যদিকে, গণমাধ্যম প্রচণ্ডভাবে আর্থিকভাবে পর্যদুস্ত অবস্থায় আছে।’
ইশতিয়াক রেজা দাবি করেন, টেলিভিশনের বেশির ভাগ বিজ্ঞাপন ভারতের চ্যানেলগুলোতে চলে যাচ্ছে। গুগল ও ফেসবুকের মতো ডিজিটাল প্লাটফরমেও বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে। এমন বাস্তবতায় গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরি ঝুঁকি বাড়ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রচেষ্টাও দেখতে পাচ্ছেন না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
‘যত দিন যাচ্ছে সাংবাদিকতায় ঝুঁকি বাড়ছে’
দৈনিক যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, ‘বৈশ্বিক কারণ, দেশের ভেতরের রাজনৈতিক অবস্থা, অর্থনৈতিক কারণ, পেশিশক্তি ও জঙ্গিদের ভয়সহ নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে এখন গণমাধ্যমকে অগ্রসর হতে হচ্ছে। গণমাধ্যম এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। যতই দিন যাচ্ছে ঝুঁকিটা বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের গণমাধ্যমে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটছে বলে আমরা দায়ী করছি তা কিন্তু নয়, আন্তর্জাতিকভাবেই যদি আমরা গণমাধ্যমের দিকে তাকাই সেখানেও আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি দারুনভাবে লক্ষ্য করছি।’
সাইফুল আলম বলেন, ‘কোন পুঁজিশক্তি গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করছে, কোন রাজনৈতিক শক্তি দেশ শাসন করছে তার ওপরও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও চিন্তার কথা নির্ভর করে। গণমাধ্যমের পেছনের মানুষগুলোও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে যদি খুব বেশি রাজনীতিকরণ হয়, সেখানে যদি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় কিংবা দেশের সব রাজনৈতিক বা পেশাজীবী সংগঠনগুলো এক আদলে চলে তাহলে সাংবাদিকদের পেশাটা ভিন্ন আদলে চলবে এটা আশা করা যায় না।’
সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে উত্তরণের ব্যবস্থা করতে হবে
সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে বসিয়েই উত্তরণের ব্যবস্থা করতে হবে বলে মত দেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল। তিনি বলেন, ‘এখানে ঐতিহ্যগতভাবে মালিকপক্ষ আছে, সাংবাদিক ইউনিয়ন আছে, সম্পাদকদের সংগঠন আছে, সাংবাদিকদেরও বিভিন্ন সংগঠন আছে। শিল্পটার সঙ্গে মালিক, সাংবাদিক, বিনিয়োগকারী সবাই জড়িত। কাজেই সবাই বসেই উত্তরণের ব্যবস্থা করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সংকটের নানা দিক আছে। বড় পুঁজির বিনিয়োগ নতুন সংকটের সৃষ্টি করেছে। যারা পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন তারা লভ্যাংশ চান। অন্যদিকে বিজ্ঞাপনের বাজার সংকুচিত হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি আসার ফলে বিজ্ঞাপন অন্যত্র চলে যাচ্ছে। ফলে ইলেকট্রনিক মিডিয়া সংকটের মধ্যে পড়েছে। দেশীয় টেলিভিশনকে প্রটেকশন দিতে সক্ষম আইনটা দ্রুত কার্যকরও করা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, এখানে সরকারের সদিচ্ছা আছে। সরকার সম্প্রচার আইন করতে চায়। আইনে খসড়া নিয়ে আমাদের আপত্তি আছে। সেটি আলোচনা করেই চূড়ান্ত হতে পারে।
গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরির আইনের যে খসড়া হয়েছে সেটি ভালো। আইনটি সংসদে পাস হলে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের আইনগত ভিত্তি তৈরি হবে বলে মনে করেন বুলবুল।
তিনি বলেন, ‘সার্বিক অর্থেই পৃথিবীজুড়ে নতুন মিডিয়ার প্রভাবের কারণে প্রচলিত মিডিয়া বা সনাতনি মিডিয়া নানা সংকটের মধ্যে পড়েছে।’ তবে তিনি আশবাদী, সংকট চিহ্নিত করে সব মহল একযোগে কাজ করলে সমাধানের পথে অগ্রসর হওয়া যাবে।
দৈনিক প্রথম আলোর হেড অব ক্রাইম রিপোর্টিং কামরুল হাসান বলেন, ‘আস্থাহীনতার মূল কারণ গণমাধ্যমকর্মীরা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করতে পারছেন না। পাঠক বা দর্শকের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না গণমাধ্যম। নিজেদের ব্যর্থতা বা চাপ— যে কারণেই হোক চাহিদা অনুযায়ী তথ্য বলতে পারছেন না সাংবাদিক।’
তিনি বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের খবর ছড়াচ্ছে। সেটা পড়েও কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারছে কেউই। ফলে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা ভেঙে যাচ্ছে।
কামরুল হাসান বলেন, ‘আগের চেয়ে সংবাদ সংগ্রহের প্রক্রিয়াও অনেক জটিল হয়ে গেছে। খবর পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। ডিজিটাল আইন নিয়ে ভয়ভীতি আছে। কী লিখলে কী হবে, কী হবে না— নানা ধরনের পরিস্থিতির কারণে সবার ভেতরে গুটিয়ে যাওয়ার ভাব এসে গেছে।’ পুরো গণমাধ্যম নিরাপদ জায়গা থেকে খবর পরিবেশন করার পদ্ধতি অবলম্বন করছে বলেও মনে করেন তিনি। তার মতে, এসব করতে গিয়ে আসলে পাঠক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং বস্তুনিষ্ট খবর মানুষ কমই পাচ্ছে।