খেলা ডেস্ক
ম্যাচের আগে দুই দলের পার্থক্য ধরা হচ্ছিল শুধু লিওনেল মেসিকে। এক দলে তিনি আছেন, আরেক দলে নেই। মাঠের খেলাতেও দুইদলকে আলাদা করা যাচ্ছিল না লম্বা একটা সময় জুড়ে। যদিও লুইস সুয়ারেজের গোলে এগিয়ে ছিল বার্সেলোনা। কিন্তু লিভারপুলও দ্বিতীয়ার্ধে ‘ভয়ঙ্কর’ অ্যাওয়ে গোলটা প্রায় পেয়ে যাচ্ছিল। ৭৫ মিনিটে মেসি করলেন ক্যারিয়ারের অন্যতম সহজ গোলটি। দুই গোলে এগিয়ে থেকেও স্বস্তি মিলছিল না ন্যু ক্যাম্পে। ৮২ মিনিটে মিলল। মেসির জাদুতে। দ্বিতীয় গোলটা হয়ে থাকবে তার ক্যারিয়ারের সেরা মুহুর্তগুলোর একটি হয়ে। গোল থেকে দূরত্ব ছিল ৩৫ গজ। গোলবারের নিচে অ্যালিসন। ওখান থেকে তাকে হারাতে অবিশ্বাস্য কিছুই করতে হতে। সেটা একজনের পক্ষেই সম্ভব ছিল। মেসি সেটাও করলেন। টপ কর্নারে বল জড়িয়ে বার্সেলোনাকে এনে দিলেন তিন গোলের লিড। এরপর বাকিটা সময় রক্ষণে মন দিয়ে আর গোল হজম করলো না বার্সা। লিভারপুল হারল ৩-০ গোলে। অ্যানফিল্ডের ম্যাচে তাই পাহাড় অতিক্রম করতে হবে ইয়ুর্গেন ক্লপের দলকে।
এই স্কোরলাইন অবশ্য ম্যাচের গল্পটা বোঝাতে পারছে না। ৭ মিনিটের ব্যবধানে মেসির জোড়া গোলের আগ পর্যন্ত ভালোভাবেই ম্যাচে টিকে ছিল লিভারপুল। যদিও এর আগে ক্লপের দলের কপাল পুড়েছিল সাবেক এক লিভারপুল খেলোয়াড়ের গোলেই। ম্যাচের আগে সুয়ারেজ বলেছিলেন গোল করলে উদযাপন করবেন। উদযাপনটা না চাইলে করতে হত সুয়ারেজকে। এই মৌসুমে ৩৫ বার গোলে শট নিয়ে বার্সার নাম্বার নাইন এতোদিন ছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগে গোলশূন্য। সেই খরাটা কাটালেন ২৬ মিনিটে।
বার্সার একাদশে চমক হয়ে এসেছিলেন আর্তুরো ভিদাল। মিডফিল্ড থেকে ডায়াগোনাল বলটা তিনিই উড়িয়ে মেরেছিলেন বাম দিকে, ফিলিপ কৌতিনহোর কাছ। তার কাছ থেকে বল পেয়ে ক্রস করেন জর্দি আলবা। সুয়ারেজ স্লাইড মেরে দারুণ ফ্লিকে গোল করে এগিয়ে নেন বার্সাকে।
এর আগেও গোলের সামনে সরব ছিল বার্সার আক্রমণ। জোল মাটিপ, অ্যান্ড্রু রবার্টসনরা ডিবক্সের ভেতর দুইবার ভালো ব্লক করে দলকে বিপদের হাত থেকে বাঁচান। কিন্তু সুয়ারেজের গোলে আর তেমন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি। দুই ডিফেন্ডারের ফাঁক গলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন উরুগুইয়ান স্ট্রাইকার।
প্রথম থেকে এতোক্ষণ পর্যন্ত কেবল ফুটবলটাই দেখছিল ন্যু ক্যাম্প। এরপর প্রথমার্ধের বাকি সময় ফুটবলের সঙ্গে একটু করে খেলোয়াড়দের হাতাহাতিও দেখা হয়ে গেল। ডাচ রেফারি বর্ন কুইপার্সও সেসব অগ্রাহ্য করে বেশ কিছু ফাউল গেলেন এড়িয়ে। এসবের মধ্যে ৩৫ মিনিটে লিভারপুল পেল ম্যাচে ফেরার দারুণ এক সুযোগ। নাবি কেইতা সুয়ারেজের গোলেরও দুই মিনিট আগে ইনজুরি নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলনে। তার জায়গায় নামা জর্ডান হেন্ডেরসনও অনেকটা আলবার মতোই দুই ডিফেন্ডারের মধ্যে দিয়ে ক্রস করেছিলেন। কিন্তু গোল থেকে ১২ গজ দূরে থাকা সাদিও মানে বল পেয়েও মেরেছেন অনেক ওপর দিয়ে।
রবার্তো ফিরমিনো ফিট ছিলেন না, তাই একাদশে তাকে রাখেননি ক্লপ। লিভারপুলের সমস্যা ছিল আরও একটা। অ্যালেক্সান্ডার আর্নল্ডের বদলে রাইটব্যাক পজিশনে আরেকটু ডিফেন্সিভ মাইন্ডেড জোল গোমেজকে নামিয়েছিলেন লিভারপুল ম্যানেজার। সিদ্ধান্তটা আক্রমণে মোটেই সাহায্য করেনি লিভারপুলকে। অন্য ফুলব্যাক রবার্টসন অবশ্য ছিলেন দারুণ।
প্রথমার্ধে বেশ কিছু হাফ চান্স নষ্ট করার হতাশা ভুলে দ্বিতীয়ার্ধে দারুণ শুরু করেছিল অলরেডরা। কোনো শট অন টার্গেট ছিল না প্রথমার্ধে, দ্বিতীয়ার্ধের ১০ মিনিটের মধ্যেই তিনবার বার্সাকে চমকে দিয়েছিল সেই লিভারপুলই। এর মধ্যে জেমস মিলনারই শট করেছেন দুইবার। প্রথমবার ডিবক্সের ডানদিক থেকে যথেষ্ট বাঁক নেওয়াতে পারেননি শটে। মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগান করেছেন প্রথম সেভ। দ্বিতীয়বার যথেষ্ট সময় পেয়েছিলেন। ডিবক্সের ঠিক মাথায় পেয়েছিলেন বল। সামনে কেবল স্টেগান। ডান বা বামদিকে মারলেই গোল পেতে পারতেন, মারলেন সোজাসুজি স্টেগানের হাতে।
মিলনারকে ওরকম জায়গায় বলটা পাঠিয়েছিলেন মোহামেদ সালাহ। জর্দি আলবার সঙ্গে পুরোটা সময় গতিতে জিতলেও, গোলের সামনে যাওয়া হচ্ছিল না তার। মিলনারকে বলটা দেওয়ার আগে, নিজেও প্রথমবারের মতো গোলে শট নিয়েছিলেন। ডিবক্সের বাইরে থেকে, গ্রাউন্ড শট মেরেছিলেন বটম কর্নারে। স্টেগান ফুল স্ট্রেচে ঠেকিয়ে দিয়েছেন সেটা।
এরপর বাধ্য হয়েই কিছুটা রক্ষণে মনোযোগী হতে হয় এর্নেস্তো ভালভার্দেকে। কৌতিনহো শুরুটা ভালো করলেও সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে গেছেন। ৬০ মিনিটে তাকে তুলে নেলসনকে নামিয়ে দেন বার্সা ম্যানেজার। রাইটব্যাকে তাকে জায়গা করে দিতে সার্জি রবার্তো উঠে যান মিডফিল্ডে। কিন্তু এরপরও লিভারপুলের লাগাম ধরতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল বার্সাকে।
তখনই স্রোতের বিপরীতে নিজের প্রথম গোলটা করেন মেসি। বল নিয়ে ডিবক্সের ভেতর ঢোকার সময় পাস দিয়েছিলেন সুয়ারেজকে। মেসি দৌড় থামাননি, চলে গিয়েছিলেন সিক্স বক্সের কাছকাছি। সুয়ারেজের শট ততোক্ষণে ক্রসবারে লেগে ফিরে গেল মেসির কাছেই। বুক দিয়ে নামিয়ে, ফাঁকা বারে আরাম করে গোল দিয়ে ন্যু ক্যাম্পে মেসি স্বস্তি ফেরান ৭৬ মিনিটে।
মেসি শো অবশ্য তখন কেবল শুরু। এর কিছুক্ষণ পর ফ্রি কিকে করলেন দুর্দান্ত সেই গোলটি। তাতে ছুঁয়ে ফেলেছেন বার্সার হয়ে ৬০০ গোলের মাইলফলকও। গোলের সঙ্গে রেকর্ডটা যেন আরও মানানসই!
তিন গোলে পিছিয়ে পড়ার পরও অবশ্য একটা অ্যাওয়ে গোলে স্বস্তি খুঁজতে পারত লিভারপুল। জেরার্ড পিকে, ক্লেমেন্ত ল্যাংলেটরা পুরো ম্যাচে তেমন একটা ভুল করেননি। কিন্তু তৃতীয় গোলের পর মনযোগ হারালেন। ফাঁকায় বদলি খেলোয়াড় ফিরমিনো বল পেয়ে গিয়েছিলেন, শট করলেন। কিন্তু গোললাইন থেকে ক্লিয়ার হলো বল। এরপর রিবাউন্ডে বল পেলেন সালাহ। ওখান থেকে গোল করারই কথা ছিল তার। কিন্তু তিনি শট করলেন বারপোস্টে। অ্যানফিল্ডে তাই শূন্য থেকেই শুরু করতে হবে লিভারপুলকে। আর পাড়ি দিতে হবে অনেক পথ, গড়তে হবে ইতিহাস।
লিভারপুলকে ম্যাচ থেকে একেবারে ছিটকেও ফেলতে পারত বার্সা। বদলি উসমান ডেম্বেলে ম্যাচের শেষ মিনিটে সহজ সুযোগ হাতছাড়া করেছেন কাউন্টার অ্যাটাক থেকে। আপাতত তাই তিন গোল নিয়েই অ্যানফিল্ডে যেতে হচ্ছে বার্সাকে। লিভারপুলে শুধু আরেকটা রোম চাইবে না ভালভার্দের দল।