দেশজনতা অনলাইন : প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটাই দাবি ছিল, হয় ছেলেদের যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার করুন, আর তা না হলে নিহত ছয় ছাত্রের বাবা-মাকে একসঙ্গে গুলি করে মেরে ফেলুন। বেঁচে থাকতে ছেলের হত্যাকারীদের বিচার দেখার আশা ছিল নিহত ইব্রাহিম খলিলের মা বিউটি বেগমের।
কিন্তু ২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবে বরাতের রাতে সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামের কেবলার চরে ডাকাতের তকমা লাগিয়ে মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের তিন শিক্ষার্থীসহ ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার মামলার বিচার শেষ হয়নি দীর্ঘ আট বছরেও। নিহত ইব্রাহিম খলিলের মা বিউটি বেগম গত প্রায় ছয় মাস আগে ছেলে হত্যার বিচারের আফসোস নিয়েই বিদায় নিয়েছেন দুনিয়া থেকে।
ছয় ছাত্রকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ৮ জুলাই ৬০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন আদালত। এরপর থেকে প্রায় শতাধিক কার্যদিবসেও সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়নি। চার্জশিটভুক্ত ৯২ সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৫২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। বিচারের এ দীর্ঘসূত্রিতায় চাঞ্চল্যকর এ মামলায় বর্তমানে সব আসামিই জামিনে মুক্ত। এ অবস্থায় সুবিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে নিহতের পরিবার।
মামলাটিতে শুধুমাত্র দুজন তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য দিলেই সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম শেষ হবে। তবে বিগত তিন কার্যদিবস ধরে তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষ্য দিতে আসছেন না। গত বছরের ১১ অক্টোবর সর্বশেষ এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। চলতি বছরের ১০ এপ্রিল এ মামলায় দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা মো. সিরাজুল হকের সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু ওইদিন তিনি না আসায় আদালত সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ২৮ এপ্রিল দিন ধার্য করেন। ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ২য় আদালতের বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহারের আদালতে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।
নিহত শিক্ষার্থী টিপু সুলতানের মা কাজী নাজমা সুলতানা বলেন, বিচার যাই হোক, আমি তো আর আমার ছেলেকে ফিরে পাবো না। অনেকের হয়তো শবেবরাত এলে ওই নির্মম ৬ ছাত্র হত্যাকা-ের কথা মনে পড়ে। কিন্তু আমি মা, আমার জন্য প্রতিদিন শবে বরাত। অপর ছাত্র নিহত ইব্রাহিম খলিলের মা বিউটি বেগমও ছেলে হত্যার বিচার চাইতে চাইতে মারা গেলেন। ছেলে হত্যার বিচার হলেও অন্তত শান্তি পেতাম।
নিহত ইব্রাহিম খলিলের বাবা আবু তাহের আলী বলেন, দেশে কত মামলার বিচার হচ্ছে আর এমন নৃশংস হত্যাকা-ের বিচার হচ্ছে না। হত্যাকারীরা ছাত্রদের হত্যার কথাও স্বীকার করেছে। এরপর আট বছর পার হয়ে গেল। ছেলের শোকেই তার মা মারা গেলো। শবেবরাতের রাতে, আল্লাহর কাছে আমার একটাই চাওয়া তা হলÑ খুনিদের বিচার চাই।
তিনি বলেন, কষ্ট পেয়ে আমার ছেলে মারা গেছেÑ এ যে কী বেদনার। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের একটাই দাবি, দয়া করে আমাদের ছেলে হত্যার বিচার করুন।
দীর্ঘদিনেও বিচার শেষ না হওয়ায় তিনি দুঃখে ও ক্ষোভে মামলার খবর নেয়া বাদ দিয়েছেন বলে জানান নিহত ইব্রাহিম খলিলের ভাই ইউসুফ আলী ।
নিহত কামরুজ্জামান কান্তর বাবা আব্দুল কাদের সুরুজ বলেন, শবে বরাত আসলেই ছেলের শোকে কাতর হয়ে যায় কান্তর মা। সারাক্ষণ কান্না করে আর আল্লাহর কাছে বিচার চায়। আমার ছেলের নামে ডাকাতির মিথ্যা মামলা দিয়েছিল। পবিত্র রাত বলে আল্লাহ’র অশেষ রহমতে সত্য ঘটনা উদ্ঘাটন হয়েছে। সরকারই (রাষ্ট্র) যখন আমার মামলার বাদী তাই বিচারের দাবিতে সরকারের দিকেই তাকিয়ে আছি।
আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের সহকারি কৌঁসুলী শাকিলা জিয়াছমিন মিতু বলেন, সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিতে না আসায় মামলার বিচার কাজ বিলম্ব হচ্ছে। মামলায় অর্ধশতাধিক জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। তবে গুরুত্বরপূর্ণ দু’এক জনের সাক্ষ্য বাদ রয়ে গেছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় তদন্ত কর্মকর্তা দীর্ঘদিন সময় ধরে সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসছেন না। গুরুত্বপূর্ণ আর কয়েকজনের সাক্ষ্য নিয়েই সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করা হবে। এ মামলায় অনেক আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছেন। সব মিলিয়ে এ মামলাটি আমরা প্রমাণ করতে সক্ষম হবো বলে আশা করছি।
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, মূলত পুলিশ এ মামলায় সহায়তা করছে না। তারা এ মামলাটি ভিন্নখাতে অর্থাৎ ডাকাতি সাজাতে চেয়েছিল। এজন্য সাক্ষীদের আনতেও তাদের তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। এ মামলায় অনেকে আসামিই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। মূলত ওই স্বীকারোক্তির ভিত্তিইে আমরা আইনী লড়াই লড়ে যাবো। আশা করছি, আসামিদের যথাযথ সাজা দেবেন আদালত।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবে বরাতের রাতে সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামের কেবলার চরে ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতরা হলেন- ধানমন্ডির ম্যাপললিফের এ লেভেলের ছাত্র শামস রহিম, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শ্রেণির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইব্রাহিম খলিল, একই কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তৌহিদুর রহমান পলাশ, তেজগাঁও কলেজের ব্যবস্থাপনা প্রথম বর্ষের ছাত্র টিপু সুলতান, মিরপুরের বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সিতাব জাবীর মুনিব এবং বাঙলা কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র কামরুজ্জামান কান্ত।
ওই ঘটনায় নিহতদের বন্ধু আল-আমিন গুরুতর আহত হলেও বেঁচে যান। ঘটনার পর ডাকাতির অভিযোগে আল-আমিনসহ নিহতদের বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় ডাকাতি মামলা করেন স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী আবদুল মালেক। ওই সময় পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা গ্রামবাসীকে আসামি করে সাভার মডেল থানায় আরেকটি মামলা করে।
পুলিশ, সিআইডির হাত ঘুরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্তভার র্যাবের হাতে দেওয়া হয়। তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ৭ জানুয়ারি র্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফ উদ্দিন আহমেদ ৬০ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন।
চার্জশিটে বলা হয়, আসামিরা নিরীহ ছাত্রদের হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর করে জখম করে। পরবর্তীকালে হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতে মসজিদের মাইকে সবাইকে ডাকাত আসার ঘোষণা দেয় এবং থানায় মিথ্যা মামলা দায়ের করে। বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র দ্বারা আঘাত করে তাদের হত্যা করা হয়।
২০১৩ সালের ৮ জুলাই আদালত ৬০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের মাধ্যমে মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু করেন। ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একমাত্র ভিকটিম আল আমিনকে একই ঘটনায় করা ডাকাতি মামলা থেকে সেদিন (চার্জ গঠনের সময়) অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এদিকে মামলায় ৯ আসামি পলাতক রয়েছেন। এরা হলেন- সাব্বির, সালাম, আফজাল, মাসুদ, শাহদাত, আমির হোসেন, মোবারক, সাত্তার ও কালাম। আর আসামি রাশেদ মারা গেছেন। এ ছাড়া প্রধান আসামি আব্দুল মালেকসহ ৫০ আসামি জামিনে আছেন। একজন মারা গেছেন। এ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ১৪ আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।