খেলা ডেস্ক
মাদ্রিদ বা তুরিন- দুই রাউন্ডেই প্রথম লেগে দারুণ পারফরম্যান্সের পরও তাদের ওপর বাজি ধরার লোকের সংখ্যা ছিল অল্প। একদিকে আয়াক্সের তরুণরা, অন্যদিকে রিয়াল-জুভেন্টাসের ‘হেভিওওয়েট’রা। কিন্তু স্পেন, ইতালি- চ্যাম্পিয়নস লিগের দুই রাউন্ডেই শেষ হাসিটা হাসল ডাচরাই। সেই ১৯৯৭ সালে শেষবার সেমিফাইনাল খেলেছিল তারা, এই মৌসুমে বাছাইপর্ব খেলে আসতে হয়েছে চ্যাম্পিয়নস লিগে। সেই আয়াক্সই ২২ বছর পর চলে গেল চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ চারে।সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর পর তুরিনের জুভেন্টাস স্টেডিয়ামও শুনল আয়াক্সের তারুণ্যের জয়গান। পিছিয়ে পড়েও তুরিনে ২-১ গোলে এবং অ্যাগ্রিগ্রেটে ৩-২ গোলের জয়ে সেমিতে গিয়ে রুপকথার গল্পটা এগিয়েই নিচ্ছে আয়াক্স।
শেষ যেবার আয়াক্স সেমিতে খেলেছিল আয়াক্স, সেবার জন্মই হয়নি এই দলের বেশিরভাগের। অধিনায়ক মাথিয়াস ডি লিটের তো নয়ই। প্রথমার্ধে তার ভুলেই লিড নিয়েছিল জুভেন্টাস, গোলের পর দলের অন্য সবার চেয়ে হতাশাটা স্পষ্ট ছিল তার মধ্যেই। কিন্তু দলটা যখন আয়াক্সের মত লড়াকু, তখন যেন শেষ বলে নেই কিছুই। প্রথমার্ধের ভুলের শাপমোচনটা দুর্দান্তভাবেই করলেন আয়াক্স অধিনায়ক ডি লিট। তার গোলেই জুভেন্টাসকে বিদায় করে দিল আয়াক্স, নিল নব্বইয়ের দশকের প্রতিশোধ।
শেষদিকে অবশ্য জয়টা হয়তো এত সহজ নাও হতে পারত আয়াক্সের। জুভেন্টাস দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ে পেতে পারত পেনাল্টি। কিন্তু হোয়াও ক্যান্সেলোর ক্রস দালি ব্লিন্দের হাতে লাগলেও পেনাল্টির বাঁশ দেননি রেফারি। সিদ্ধান্ত বদলায়নি ‘ভিএআর’-এও। তাতেও অবশ্য খুব বেশি লাভ হত না জুভেন্টাসের। তাদেরকে আসলে করতে হত দুই গোল। ডি লিটের দ্বিতীয় গোলের পর ম্যাচটা আয়াক্সের হাতেই ছিল। শেষদিকে আর তারাও পথ হারায়নি, তাই নিঃশেষ হয়ে গেছে এই মৌসুমে জুভেন্টাস ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর চ্যাম্পিয়নস লিগ যাত্রাটা।
অবশ্য জুভেন্টাসকে শেষ চারে নেওয়ার সম্ভাব্য সবকিছুই করেছেন রোনালদো। প্রথম লেগের মত আজও পেয়েছেন গোল। অবশ্য রোনালদোর গোলে ডি লিটের ‘অবদান’ও কম নয়। ২৮ মিনিটে ডি লিটের ধাক্কা খেয়ে ডিবক্সে পড়ে যান রোনালদোকে মার্ক করতে যাওয়া ভেল্টম্যান। ডিবক্সে ফাঁকা জায়গা পেয়েই ওনানাকে পরাস্ত করতে ভুল করেননি ‘সিআর৭’। পুরো তুরিনে তখন শোনা যাচ্ছে রোনালদোর ‘সিইইইই’ উদযাপনের ধ্বনি।
পিছিয়ে পড়েও ফিরে আসাটাকে যেন ‘রুটিন’ই বানিয়ে ফেলেছে তারা। আয়াক্সের হার না মানা মনোভাব আজও অটুট ছিল তুরিনে। ডেভিড নেরেসের পাস থেকে ডিবক্সে বল পেয়েও জুভেন্টাস গোলরক্ষক ওয়েচেক শেজনিকে পরাস্ত করতে পারেননি ভ্যান ডি বিক। তবে ডি লিটের মত শাপমোচনের সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন তিনিও। ৩৪ মিনিটে হাকিম জিয়েচের শট বনুচ্চির গায়ে লেগে তার পায়ে আসলে ঠান্ডা মাথায় শেজনিকে পরাস্ত করেন তিনি। অফসাইডের ভেবে ডি বিককে চার্জ না করার চড়া মূল্যই দিতে হয়েছে মাসিমিলিয়ানো আলেগ্রির দলের। নেরেস-জিয়েচ-তাদিচদের সামলাতে রীতিমত নাকানিচুবানি খেতে হয়েছে বনুচ্চিদের। জুভেন্টাসের রক্ষণে জর্জিও কিয়েলিনির অভাবটা বেশ ভুগিয়েছে তাদের।
তুরিনে আজ ব্যবধানটা মাত্র ২-১ হওয়ার পেছনে অন্যতম অবদান অবশ্যই শেজনির। দ্বিতীয়ার্ধে অন্তত তিনটি নিশ্চিত গোল বাঁচিয়েছেন তিনি। দ্বিতীয়ার্ধে আয়াক্স রীতিমত ‘টোটাল ফুটবল’ই। রক্ষণ থেকে আক্রমণে এগিয়ে এসেছেন ডি লিট, ব্লিন্দরা। কিন্তু শেজনির সামনে বারবার খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাদের। ৫০ মিনিটে ডি বিক এবং এর মিনিট চারেক পর জিয়েচের আরও একটি দুর্দান্ত বাঁকানো শট হাওয়ায় ভেসে ফিরিয়ে দিয়েছেন পোলিশ গোলরক্ষক। গোছানো আক্রমণের সাথে আজ প্রতি-আক্রমণেও সমান দুর্দান্ত ছিল টেন হাগের দল। ৬২ মিনিটে তাদিচ-জিয়েচের বোঝাপড়ায় লিড নিতে পারত আয়াক্স। কিন্তু মিরালেম পিয়ানিচের দুর্দান্ত ব্লকে আবারও খালিহাতে ফিরতে হয়েছে তাদের। সব মিলিয়ে অতিরিক্ত সময়ের দিকেই এগুচ্ছিল ম্যাচ। কিন্তু তখনও যে শাপমোচন বাকি ছিল ডি লিটের।
৬৭ মিনিটে কর্নার থেকে জুভেন্টাসের চার ডিফেন্ডারের উপরে লাফিয়ে হেড করে শেজনিকে পরাস্ত করে তিনি। পুরো তুরিনে তখন পিনপতন নীরবতা। ম্যাচের বাকি ২০ মিনিটে তখন দুই গোল করতে হত জুভেন্টাসকে। আয়াক্সের রক্ষণভাগকে তো রোনালদোরা পরীক্ষায় ফেলতেই পারেননি, উলটো আরেকটু হলেই জুভেন্টাসের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিতে পারতেন জিয়েচ। ৭৯ মিনিটে দুর্দান্ত গোলে বল জালে পাঠিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু অফসাইডে বাতিল হয়েছে গোল। শেষ পর্যন্ত আর ফিরে আসা হয়নি রোনালদোদের। তারুণ্যে জয়গানে শেষ চারে চলে গেল আয়াক্স।
এই জুভেন্টাসের কাছেই পেনাল্টিতে ১৯৯৬ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল হেরেছিল আয়াক্স। ড্রয়ের পর থেকে সেই ম্যাচের প্রতিশোধের কথাই বলছিলেন আয়াক্সের অনেকে। ২৩ বছর পর ইউরোপে জুভেন্টাসকে পেয়েই পূর্বসুরিদের হয়ে প্রতিশোধ নিলেন ডি লিটরা। আর তিন ম্যাচ দূরেই চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা। ডি লিটরা কি পারবেন ক্লাব ছাড়ার আগে আয়াক্সের ইতিহাসে অমরত্ব নিশ্চিত করতে?