দেশজনতা অনলাইন : নিপীড়নের প্রতিকার চেয়ে ফেনীর সোনাগাজী ইসলামী সিনিয়র মাদ্রাসার অধ্যক্ষের লোকজনের দেয়া আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া নুসরাত সবার জন্য শিক্ষা বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। তিনি বলেছেন, নিজের জীবন দিয়ে প্রতিবাদ করে গেছেন নুসরাত। তার প্রতিবাদ সবার জন্য শিক্ষণীয়।
বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির লাশ দেখতে এসে তিনি এসব কথা বলেন।
কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত শুধু একজন মেয়ে না, সে একটি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। সে অন্যায়ের কাছে, কারও যৌন লালসার কাছে নত হয়নি। নুসরাত আজকে তার নিজের জীবন দিয়ে প্রতিবাদ করে গেলেন। অনেকেই অন্যায়ের কাছে নত শিকার করেন, সায় দেন। কিন্তু নুসরাত সেটি করেননি। আমার মতে, আজকের দিনটি যৌন নির্যাতনবিরোধী ‘নুসরাত ডে’ হিসেবে আমাদের স্মরণ রাখা উচিত।’
যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে একটি আইন করার দাবি জানিয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা দাবি করছি- যৌন নিপীড়নের জন্য একটি আইন করার। আদালত থেকে একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে— যৌন হয়রানির জন্য একটি কঠিন আইন করতে হবে। দ্রুততম সময়ের ভেতরে বিচার সম্পন্ন করতে হবে। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা সেই জিনিসটা এখনও করতে পারিনি।’
নিপীড়নের অভিযোগে নুসরাতের মামলা না নেয়ায় পুলিশের ভূমিকার প্রতিবাদ জানিয়ে কাজী রিয়াজুল হক বলেন, প্রাথমিকভাবে নুসরাতের যে মানবিক মর্যাদাহানি করা হয়েছে, তারও বিচার হওয়া উচিত। থানার ওসিকে প্রত্যাহার করেই যেন সব শেষ না হয়। বিষয়টি তদন্ত করে তার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
বুধবার রাত সাড়ে ৯টায় না ফেরার দেশে চলে যান ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি (১৮)।
হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চিকিৎসক অধ্যাপক রায়হানা আউয়াল যুগান্তরকে জানান, মৃত্যুর আগে তিনি লাইফসাপোর্টে ছিলেন।
লাইফসাপোর্টে যাওয়ার আগেও রাফি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। দগ্ধ হওয়ার আগে দুই বান্ধবীর কাছে লেখা চিঠিতে তিনি ঘটনার শেষ দেখার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। কিন্তু তার শেষ দেখা হলো না। এর আগেই নিভে গেল জীবনপ্রদীপ। রাতে তার মরদেহ হিমঘরে রাখা হয়। সকালে হিমঘর থেকে তার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজীতে পরীক্ষাকেন্দ্রের ভেতর ওই ছাত্রীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে হত্যাচেষ্টা চালায় দুর্বৃত্তরা। শনিবার সকালে সোনাগাজী পৌর এলাকার ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসাকেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। ওই ছাত্রী ওই মাদ্রাসা থেকেই আলিম পরীক্ষা দিচ্ছিলেন।
পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত কক্ষ থেকে ছাদে ডেকে নিয়ে কয়েকজন বোরকাপরা নারী পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ করেছেন ওই শিক্ষার্থীর পরিবারের সদস্যরা। তারা জানান, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে দায়ের করা মামলা তুলে না নেয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। এ তথ্য ফেনী সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্থানীয় পুলিশকেও জানিয়েছেন ওই শিক্ষার্থী। তার অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় এদিন বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের ১০২ নম্বর কক্ষে ভর্তি করা হয়। পরে তাকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়।তাকে লাইফসাপোর্ট দেয়া হয়েছে। শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক করতে মঙ্গলবার তার অস্ত্রোপচারও হয়। অস্ত্রোপচারের পরও তাকে নিয়ে শঙ্কা কাটেনি বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকরা।
পরিবার ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন ওই ছাত্রীর মা। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৭ মার্চ সকাল ১০টার দিকে অধ্যক্ষ তার অফিসের পিয়ন নূরুল আমিনের মাধ্যমে ছাত্রীকে ডেকে নেন। পরীক্ষার আধাঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ওই ছাত্রীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন অধ্যক্ষ। পরে পরিবারের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হন অধ্যক্ষ। সেই মামলা তুলে না নেয়ায় অধ্যক্ষের লোকজন ওই ছাত্রীর গায়ে আগুন দিয়েছে।
এদিকে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেফতার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পিকেএম এনামুল করিমের সভাপতিত্বে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার গভর্নিং কমিটির সভায় রোববার এ সিদ্ধান্ত হয়। সভায় ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া সভায় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষকদের পক্ষ থেকে অগ্নিদগ্ধ ছাত্রীর চিকিৎসায় দুই লাখ টাকা অনুদান দেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়।
সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে শিশু বলাৎকারের ঘটনায় ফেনী সদরের একটি মাদ্রাসা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে নাশকতা, যৌন হয়রানি ও চেক জালিয়াতিসহ ফেনী এবং সোনাগাজী মডেল থানায় ছয়টি মামলা রয়েছে।