অনলাইন ডেস্ক:
সৌদি আরবের নেতৃত্বে কাতারের সঙ্গে ছয়টি মুসলিম দেশের সম্পর্ক ছিন্নের পদক্ষেপে ইসরাইল সন্তোষ প্রকাশ করেছে। দৃশ্যতঃ ইসরাইলের এতোদিনের অভিযোগের ভিত্তিতেই কাতারের বিরুদ্ধে এ পদক্ষেপ নিয়েছে সৌদি ও তার মিত্ররা।
কাতারবিরোধী পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাভিগদর লিবারম্যান বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে এটা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।’
ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের প্রতি কাতারের সমর্থনের কারণে দেশটির ওপর আগে থেকেই ক্ষুব্ধ তেল আবিব। সম্পর্ক ছিন্নের বিষয়টিকে মওকা হিসেবে নিয়েছে তারা।
ইসরাইলের একটি রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইসরাইলের ডায়মন্ড ইন্সটিটিউটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এলি আভিদার বলেছেন, হামাসের বেঁচে থাকার জন্য উপসাগরীয় অঞ্চলের সমৃদ্ধ অর্থনীতির এ দেশটি অপরিহার্য। কাতারের অর্থায়ন ছাড়া ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় হামাসের পক্ষে ক্ষমতায় থাকা কিংবা ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়।
ইসরাইলের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক সাবেক এ উপদেষ্টা বলেন, ‘ইসরাইল হয়তো হামাসের ওপর প্রভাব বিস্তারে কাতারের বর্তমান কূটনৈতিক পরিস্থিতি ব্যবহারের চেষ্টা করবে। তবে এটা হবে ভুল। এখন যা ঘটছে সেটা দুনিয়াজুড়ে একটা নাটকীয় পরিবর্তনের পালা।’
এক সময় কাতারে ইসরাইলি গুপ্তচর হিসেবে কাজ করা এলি আভিদার বলেন, এই রাজনৈতিক কম্পনের ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যে হাজার হাজার বিদেশি নাগরিক কাতার ছাড়বেন।
তিনি আরো বলেন, ‘তবে এটা বুঝতে হবে, কাতারি নেতা বয়সে যুবক। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিনি পুরোপুরি একা হয়ে পড়েছেন। তিনি আতঙ্কের মধ্যে আছেন। প্রতিবেশী দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের জন্য তিনি যে কোনো কিছুই করার চেষ্টা করবেন। হোয়াইট হাউসকে চাপ দিতে তিনি কাতারে ব্যবসা রয়েছে এমন মার্কিন কোম্পানিগুলোকে ব্যবহার করবেন।’
এ ছাড়া আরো যেসব কারণে মুসলিম দেশগুলোর কাতার বিরুদ্ধে অবস্থানকে দখলদার ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল মহাখুশি তা নিম্নে দেয়া আলোচনা করা হলো-
১. ইসরাইল মনে করে, বিগত এক দশক ধরে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসকে সমর্থন দিয়ে আসছে কাতার। এ ছাড়া হামাসের নেতা খালিদ মিশাল পাঁচ বছর কাতারের রাজধানী দোহায় বসে তার দল পরিচালনা করছেন।
খালেদ মিশাল ছাড়াও হামাসের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা কাতারে রয়েছেন। তারা সেখান থেকে দলের কার্যক্রম চালাচ্ছেন। এ কারণে কাতারের ওপর মহাক্ষ্যাপা ইসরাইল।
এদিকে ২০১২ সালে কাতারের আমির শেখ হামাদ বিন খলিফা আল-থানি গাজা সফর করে ১০০ মিলিয়ন সহায়তার ঘোষণা দেন। কাতার ফিলিস্তিনকে শুধু অর্থায়নই করে না, বিশ্বব্যাপী তাদের হয়ে কূটনীতিক লবিও করে থাকে। ইসরাইল মূলত হামাস দমনে কাতারের ওপর তৈরি হওয়া নতুন এই চাপকে কাজে লাগাতে চাইছে। ফলে কাতার সংকট হামাসের জন্যও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসবে দেখা দিয়েছে।
২. ইরান বিরোধিতায় সৌদি আরব, মিশর ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের জায়গায় ছিল ইসরাইল। আরব দেশগুলোর কাতারের বিরুদ্ধে এই অবস্থানকে হামাস ও ইরানের বিপক্ষে নিজেদের অবস্থানকে আরো সংহত করার চেষ্টা করবে ইসরাইল।
সৌদি আরবভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-আরাবিয়া এরই মধ্যে সাম্প্রতিক আলোচিত হলিউড মুভি ‘ওয়ান্ডার উইমেন’র অভিনেত্রী গাল গ্যাদতের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। এই অভিনেত্রী একজন ইসরাইলি সেনাসদস্য।
৩. কাতারের সঙ্গে মুসলিম দেশগুলোর সম্পর্ক ছিন্নের বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কলকাঠি নেড়েছেন। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইরান ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে নমনীয় মনোভাব দেখালেও মধ্যপ্রাচ্য সফরে এসে ট্রাম্প ‘সন্ত্রাসবাদ’ ইস্যুতে এক ধরনের ব্ল্যাঙ্ক চেক প্রদান করেছেন। ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের শুরুতেই ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই সুযোগে ইসরাইল মনে করছে, এই অঞ্চলে আমেরিকার প্রভাব বৃদ্ধিতে তারা আরো সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
৪. ইসরাইলের দাবি, মধ্যপ্রাচ্যে ‘বিভিন্ন সন্ত্রাসী’ গোষ্ঠীকে মদদ দিয়ে আসছিল ইরান ও কাতার। নতুন নিষেধাজ্ঞায় ইসরাইল মনে করছে, সিনাইয়ে নুসরা ফ্রন্ট, গাজায় হামাস, লেবাননে হিজবুল্লাহর জিহাদিদের শক্তি কমে আসবে।
৫. মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের জন্য ইসরাইলকে দায়ী করা হতো। ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত থাকতো মধ্যপ্রাচ্য। সিরিয়া ও ইরাক যুদ্ধের কারণে দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরলেও এবার ফিলিস্তিন থেকে বেশ বড় আকারে পিছুটান হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
ইরান নিয়ে বছরের পর বছর শুধু ইসরাইলই আওয়াজ তুলে আসছিল। এখন পারস্য উপসাগরীয় সব দেশ সমস্বরে আওয়াজ তুলছে। এটা ইসরাইলের জন্য ইতিবাচক। মিশর ও জর্দানের সঙ্গে শুধু সম্পর্ক নয়, এবার মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশের কাছাকাছি আসছে ইসরাইল। সব মিলিয়ে কাতার বয়কটের ইস্যুটা ইসরাইল নিজেদের জন্য বিশেষ মওকা হিসেবে দেখছে।
উল্লেখ্য, গতকাল সোমবার কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেয় ছয়টি আরব দেশ। দেশগুলো হচ্ছে, সৌদি আরব, মিশর, বাহরাইন, লিবিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইয়েমেন।
দেশগুলোর পক্ষ থেকে কাতারের বিরুদ্ধে ‘আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা তৈরি ও সন্ত্রাসবাদ উস্কে’ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।
অবশ্য কাতার বলছে, ‘মিথ্যা ও ভিত্তিহীন দাবিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর লক্ষ্য পরিষ্কার- তারা আমাদের ওপর রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার এবং খবরদারি করতে চায়। এটা কাতারের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত।’
সূত্র: জেরুজালেম পোস্ট, আরব নিউজ ও আল-আরাবিয়া
দৈনিক দেশজনতা/এমএম