২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১:১২

নির্বাচন বর্জনের চিন্তাই এখন চরম আত্মঘাতী হবে

নির্বাচনের তফসিল বদলে ভোটগ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮। বছর শেষ হওয়ার আগের দিন দেশে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক সংকটের আপাতত একটি সমাধান শেষে নতুন বছরে পা রাখার এই সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক জোট হিসেবে সদ্য আত্মপ্রকাশকারী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তাতে খুশি নয়। তারা বলতে চাইছে যে, ভোটগ্রহণ পিছিয়ে জানুয়ারির মধ্যভাবে নেয়া হোক, এর কারণ হিসেবে তারা মূলত বিদেশিদের পক্ষে বছর শেষের ছুটি কাটাতে বাংলাদেশে না থাকার অজুহাতটিকেই বড় করে দেখছেন।

আমরা স্মরণ করতে পারি যে, ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনও ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ অর্থাৎ ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তখন এই প্রশ্ন কেউ তোলেনি যে, এর ফলে বছর শেষের ছুটি কাটাতে বিদেশিরা বাংলাদেশের বাইরে থাকবে, সুতরাং নির্বাচনে কারচুপি করা সহজ হবে।

২০১৪ সালের মত এবারও সে রকম কিছু করলে দলটির (বিএনপি) অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের সার্বিক রাজনীতির জন্যও সেটা কোনো স্বস্তিদায়ক বিষয় হবে না

যুক্তিটা এ কারণেই খোঁড়া যে, এর ফলে নিজেদের রাজনৈতিক সক্ষমতাকেও অনেক বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় এবং নিজেদের রাজনৈতিক সংকটের জন্য বিদেশি মুরুব্বিদের দ্বারস্থ হওয়ার ক্ষুদ্রতাও প্রকট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদ্যমান সংকট সমূহকে তালিকাভুক্ত করা হলে এই বিদেশি-নির্ভরতা তালিকার প্রথম দিকেই স্থান করে নেবে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। এবং এক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক দলই কারো চেয়ে কম যায় না।

আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকাকালেও বিদেশিদের কাছে ধর্ণা দিয়েছে দেশের অভ্যন্তরীন পরিস্থিতি নিয়ে আর বিএনপি বিষয়টিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে গত দশ বছরের বিরোধী রাজনীতি করতে গিয়ে। এখন এমন অবস্থায় এসে পৌঁছেছে দলটি যে, তাদের দিন শুরু হয় বিদেশিদের কাছে নালিশ করে এবং দিন শেষও হয় এই নালিশের মধ্য দিয়ে। দেশের নাগরিককে এ রকমভাবে খাঁটো করার অধিকার কোনো রাজনৈতিক দলের আছে কি না সে প্রশ্ন নিশ্চয়ই ভোটাররা তুলতে পারেন এবং সে প্রশ্ন তোলার সময় এখনই।

আমরা জানি যে, মাত্র অল্প সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশে একটি সুস্থ ধারার রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। স্বীকার করতেই হবে যে, এই পরিস্থিতি সৃষ্টিতে উভয় পক্ষের সদিচ্ছা রয়েছে। বিশেষ করে বিএনপির রাজনীতি পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, রাজনৈতিক সংকটকে দলটি শুরু থেকেই উত্তুঙ্গে নিয়ে গিয়েও নিজেদের জেদ বজায় রাখতে তারা পিছপা হয় না। ছিয়ানব্বইয়ের একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং তার ফলশ্রুতিতে দেশের রাজনীতিতে নতুন অচলাবস্থার সৃষ্টি হওয়া ও শেষ পর্যন্ত একটি নতুন সরকার-ব্যবস্থা প্রণয়নে গিয়ে সেটি শেষ হওয়ার ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা।

অপরদিকে ২০০৬ সালে এসে আবারও সেই রাজনৈতিক গোয়ার্তুমি আমরা দেখি, শেষ পর্যন্ত একই ব্যক্তির রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার ফলাফল হিসেবে একটি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে জাতিকে ফেলে বিএনপি কেবলমাত্র নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল তা’ই নয়, তারপর থেকে বিএনপির রাজনীতিও জিয়া পরিবারের হাত থেকে ফসকে যেতে শুরু করে। অনেকেই এই বিতর্ক তুলতে পারেন যে, বিএনপির নেতৃত্ব জিয়া পরিবারের হাতে থাকার ফলেই দেশের চলমান রাজনীতিতে দু’টি বৃহৎ পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক কখনও স্বচ্ছন্দ্য হতে পারেনি। বিশেষ করে, ১৫ আগস্ট বেগম জিয়ার জন্মদিন পালন এবং ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার সঙ্গে তারেক জিয়ার নাম জড়ানোর ফলে রাজনীতিতে দু’পক্ষের মধ্যে সম্পর্ক ব্যক্তিগত শত্রুতায় পর্যবশিত হয়েছিল। এই মুহূর্তে যদি বেগম জিয়া কিংবা তারেক জিয়া সশরীরে উপস্থিত থেকে বিএনপির রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন তাহলে কি আজকের মতো এ রকম রাজনৈতিক পরিবেশ আমরা দেখতে পেতাম? অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করবেন তাতে। কিন্তু দেশের মানুষ রাজনীতিতে এ রকম একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় থাকুক সেটা চাইছেন।

বিএনপির নেতাকর্মী, সমর্থক কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষীদেরও অনেকেই এ কথা স্বীকার করে থাকেন যে, আজকে যে দলটি চরমতম সংকটের মধ্যে পড়েছে তার অন্যতম কারণ দলটির নেতৃত্বে থাকা জিয়া পরিবারের সদস্যদের দ্বারা দলটিকে কেবল নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা। এর ফলে দলটির বিশাল সমর্থকগোষ্ঠীর স্বার্থের কথা বিবেচনায় না এনে পরিবারকে প্রাধান্য দেওয়ায় দলটির ভেতরেই ক্ষোভ তৈরি হয়েছে এবং স্বার্থের দ্বন্দ্বে দলের বর্ষীয়ান নেতৃত্ব থেকে তরুণ নেতৃত্বকে দল থেকে দূরে সরতে দেখা গেছে। ১/১১-র পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পর থেকে যে সকল নেতৃবৃন্দ বিএনপির পাশ থেকে সরে গিয়েছিল তাদের বেশিরভাগই জিয়া পরিবারের একগুঁয়েমিকে কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছিল। অপরদিকে আওয়ামী লীগে যারা ১/১১-র সময় দলের বিরোধীতা করতে চেয়েছিল তারা মূলত শেখ হাসিনা-বিদ্বেষ থেকেই এ পথে নেমেছিল। কিন্তু সে সমস্যা আওয়ামী লীগ কাটিয়ে উঠতে পারলেও বিএনপি কতটা পেরেছে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকেরই।

সরকারি দল ‘ফাউল’ খেলার চেষ্টা করলে জনগণ সেটা মেনে নেবে বলে মনে হয় না। দলটিকে বেশ সংকটের ভেতর ফেলতে সক্ষম হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট

এখন যখন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম জিয়া দুর্নীতির দায়ে ১৭ বছরের কারাদণ্ড (দুই মামলায়) মাথায় নিয়ে জেলে শাস্তি ভোগ করছেন এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হিসেবে তারেক জিয়াও কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে বিদেশে পলাতক জীবন যাপন করছেন তখন দলটিকে ভর করতে হয়েছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বের ওপর, রব-মান্না-কাদের সিদ্দিকীর মতো নেতাদের খবরদারির ওপর এবং শোনা যাচ্ছে আসন ভাগাভাগি নিয়ে ইতোপূর্বে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে যে বিতণ্ডা সৃষ্টি হয়েছিল সেই একই বিতণ্ডা সৃষ্টি হতে যাচ্ছে নবগঠিত ঐকফ্রন্টের শরীকদের ক্ষেত্রেও। কিন্তু রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য দলটিকে হয়তো এটাও মেনে নিতে হবে এবং যুক্তফ্রন্টের শরীকদেরকে যুক্তির বাইরেও ছাড় দিতে হবে বিএনপিকে।

কিন্তু ঠিক এ রকমই একটি সময়ে বিএনপি মহাসচিবের একটি হুমকি বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে দেশের অন্যতম প্রধান একটি দৈনিক। সেখানে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার হুমকি দিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মজার ব্যাপার হলো, এই মুহূর্তে বিএনপি কি ঠিক সেই জায়গাতে আছে কি না সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে আগে। যে পরিস্থিতিতে বিএনপি-সমর্থিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে তা কেবল অভূতপূর্বই নয়, বরং সকলের কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিশেষ করে, যে ৭-দফা দাবি নিয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন জোটের সঙ্গে সংলাপে বসেছে তার কোনোটিই সেই অর্থে মানা হয়েছে বলে কেউ মনে করেন না। কিন্তু তারপরও নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে সময়োপযোগী এবং বলকে সরকারি দলের কাছে ঠেলে দেওয়ার চমৎকার কৌশল হিসেবেই দেখছে সকলে।

এই কৌশলে যদি সরকারি দল ‘ফাউল’ খেলার চেষ্টা করে তাহলে জনগণ সেটা মেনে নেবে বলে মনে হয় না। ফলে আওয়ামী লীগ-কল্পিত সুবিধাজনক স্থান থেকে দলটিকে বেশ সংকটের ভেতরই এনে ফেলতে সক্ষম হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিয়ে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, দীর্ঘ দশ বছর পর বিএনপির নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন ভোটের আনন্দে। তারা কি মেনে নেবেন কোনোভাবে যদি মির্জা ফখরুল কথিত নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে বদলানো হয়? আরও বড় কথা হলো, তাতে কি আওয়ামী লীগ বসে থাকবে নির্বাচন না করে? ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ বসে থাকেনি এবং তারা পাঁচ বছর দেশ চালিয়ে তাদের রাজনৈতিক সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। সংগঠন হিসেবে বিএনপির দুর্বলতার সুযোগ সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে আওয়ামী লীগ। আরও একটি পয়েন্ট আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ২০১৩ সালে শুরু হওয়া দেশব্যাপী আগুন-সন্ত্রাস বিএনপিকে আসলে রাজনৈতিকভাবে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। দেশ ও দেশের মানুষ এটা ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। এখনও যে নবগঠিত ঐক্যফ্রন্ট কোনো ধরনের আন্দোলনের পথে যাচ্ছে না সেটা সেই অভিজ্ঞতা-লব্ধ শিক্ষা। সুতরাং, নতুন করে নির্বাচন বর্জন কিংবা কোনো অজুহাত দেখিয়ে নির্বাচনকে বানচাল করার চেষ্টা হবে আত্মঘাতী, সেটা যে পক্ষই করুক না কেন।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে যে ভয়ঙ্কর দূরবস্থার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল দীর্ঘদিন সেই দুঃসহ রাজনৈতিক অচলায়তনে থেকেই দলটি ধীরে ধীরে নতুন করে শক্তিশালী হওয়ার সক্ষমতা দেখিয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণে। বিএনপি এখন যে দুঃসময় পার করছে তার জন্য দলটির নেতৃত্ব এককভাবে দায়ী, যে কথা আগেই বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের দূরবস্থা আর বিএনপির দূরবস্থা কোনোভাবেই এক নয় বা তুলনীয় নয়, কিন্তু এর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির যে শিক্ষণীয় অনেক কিছুই রয়েছে তা বলাই বাহুল্য।

আওয়ামী লীগ তার দুঃসময় কাটাতে এমন কোনো নির্বাচন নেই যাতে সে অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচনই যে রাজনৈতিক দুঃসময় অতিক্রম করার সবচেয়ে বড় মহৌষধ তা আওয়ামী লীগ প্রমাণ করেছে। কিন্তু বিএনপি প্রথমবারেই সেই সক্ষমতা প্রমাণের সুযোগ হাতছাড়া করেছে ২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে। ফলে এবারও যদি সে রকম কিছু করে তাহলে দলটির অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের সার্বিক রাজনীতির জন্যও সেটা কোনো স্বস্তিদায়ক বিষয় হবে না, সেটাও আমাদের মানতে হবে।

প্রকাশ :নভেম্বর ১৩, ২০১৮ ৪:০৬ অপরাহ্ণ