ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোট সরকারের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দ্বিতীয় দফার সংলাপে সাত দফার আলোকে সুনির্দিষ্ট চারটি প্রস্তাব দেয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এগুলো হলো- সংসদ ভেঙে দিয়ে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন, ১০ সদস্যের নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার গঠন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি।
ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যে দাবি করেছে, তা মূলত নির্বাচন পেছানোর বাহানা।’ বুধবার সংলাপ শেষে গণভবন থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের কাছে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
বুধবার বেলা ১১টা ১০ মিনিটে গণভবনের ব্যাংকোয়েট হলে শুরু হওয়া এই সংলাপে দুই পক্ষেই ১১ জন করে অংশ নেন। এটি শেষ হয় দুপুর ২টার কিছু পরে। বৈঠকটি রুদ্ধদ্বার হয়।
‘দ্বিতীয় দফা সংলাপেও কোনো সমাধান পাননি’ বলে জানান জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না। গণভবনে সংলাপ শেষে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আলোচনা মনঃপূত হয়নি। সংলাপে কোনো সমাধান আসেনি।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পরে সংলাপের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাবে বলেও জানান নাগরিক ঐক্যের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না।
গত ১ নভেম্বর ঐক্যফ্রন্টের ২০ নেতার সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও শরিক ২৩ নেতার সাড়ে তিন ঘণ্টার সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সংলাপে আওয়ামী লীগের পক্ষে নেতৃত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে নেতৃত্ব দেন গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। সাত দফা দাবির বিষয়ে সমাধান না আসায় ‘সীমিত’ পরিসরে দ্বিতীয় দফার সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।
দ্বিতীয় সংলাপ শেষে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘সংবিধান অনুসারে যখন নির্বাচন হওয়ার কথা, ঐক্যফ্রন্টের নেতারা সেটির পরিবর্তে সংসদ ভেঙে দিয়ে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের দাবি করেছেন। এর মাধ্যমে তারা নির্বাচন পেছানোর বাহানা করছেন।’
আশঙ্কা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের দাবিগুলোর মাধ্যমে আমরা আবারও ১/১১’র মতো অপশক্তির অস্বাভাবিক সরকার আসার আশঙ্কা করছি।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, সংসদ যেদিন বসেছে সেদিন থেকে হিসাব করে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু তারা সংলাপে প্রস্তাব দিয়েছেন নির্বাচন সংসদের মেয়াদ শেষে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে করার। কিন্তু এটা সংবিধানের বাইরে। তাই আমরা এতে সম্মত হইনি। আর একজন প্রধান উপদেষ্টাসহ ১০ জন উপদেষ্টা রেখে নির্বাচন করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু সেটিও গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তাদের অনুরোধ করেছেন, আপনারা নির্বাচনে আসুন, আমরা দেখিয়ে দেবো এই সরকারের অধীনেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। এরপর যদি আপনারা জিতেন আপনারা ক্ষমতায় আসবেন, আর আমরা জিতলে আমরা আসবো।
ওবায়দুল কাদেরের দাবি, ‘আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। তাদের অনেক দাবি আমাদের মেনে নিতে কোনো আপত্তি নেই। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাদের আশ্বস্ত করেছেন— অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে যা করণীয়, সবই করা হবে। মন্ত্রীরা নির্বাচনের প্রচারণায় কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেবেন না।’
‘ভবিষ্যতে আর আলোচনার কোনো সুযোগ নেই। ডায়ালগ শেষ, আলোচনা চলবে’- যাওয়ার আগে এমনও মন্তব্য করেন ওবায়দুল কাদের।
এদিকে, ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বুধবার সকালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেন, সরকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রাখতে চেয়ে যদি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে চান তাহলে সাত দফা দাবি নিয়ে একটি সুচিন্তিত মতামত আসবে বলে আমরা মনে করি।
তিনি বলেন, ‘দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আমরা যে আন্দোলন শুরু করেছি, সে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এর মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বিজয়কে সুসংহত করতে হবে।’
সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যে ৭ দফা দাবি নিয়ে আলোচনা কথা রয়েছে সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আলোচনা হবে, আলোচনার পরে সব জানতে পারবেন।
ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা হলো- সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার গঠন, খালেদা জিয়াসহ রাজবন্দিদের মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার নিশ্চিত করা, যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন ও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, শিক্ষার্থী, সাংবাদিকসহ সবার বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সব কালো আইন বাতিল, নির্বাচনের ১০ দিন আগে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন, দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগ ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করা এবং নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে ফলাফল চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রেখে নতুন কোনো মামলা না দেয়া।
সংলাপে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের মধ্যে ছিলেন ড. কামাল হোসেন, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফা মোহসীন মন্টু, গণফোরামের কার্যকরী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, নাগরিক ঐক্যের নেতা এস এম আকরাম, জেএসডি সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন ও ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দলের প্রতিনিধিদলে ছিলেন— আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিম, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, ডা. দীপু মনি, অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।
গত ১ নভেম্বর গণভবনে বহু আলোচিত প্রথম দফা সংলাপ শেষে গণফোরাম সভাপতি কামাল বলেছিলেন, এ আলোচনায় বিশেষ কোনো সমাধান তারা পাননি। আর জোটের সবচেয়ে বড় দল বিএনপির ফখরুল সাংবাদিকদের বলেন, আলোচনায় তারা সন্তুষ্ট নন।
এরপর গত ৪ নভেম্বর আবার সংলাপ চেয়ে কামালের পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হলে বুধবার বেলা ১১টায় ‘ছোট পরিসরে’ সংলাপের সময় দেয়া হয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে।
গতকাল মঙ্গলবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐক্যফ্রন্টের জনসভা থেকে মির্জা ফখরুল ঘোষণা দেন, সংলাপে তাদের দাবি পূরণ না হলে ৮ নভেম্বর রাজশাহী অভিমুখে রোড মার্চ করবেন তারা। রাজশাহীতে ৯ নভেম্বর ঐক্যফ্রন্টের জনসভা হবে।
আর সমঝোতার আগেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলে নির্বাচন কমিশন অভিমুখে পদযাত্রার ঘোষণা দেন ঐক্যফ্রন্টের সবচেয়ে বড় দল বিএনপির এই নেতা।
বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করে সংলাপের ‘ফলাফল’ জানানোর কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর।