সংলাপের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। দুই পক্ষই নিজেদের মত করে বিশ্লেষণ করছে। নিজেদের অর্জন যাচাই করে নিচ্ছে।
সংলাপ আসলে একটা মাইন্ড গেম। এখানে কথা হবে, দাবি উঠবে; পাল্টা কথা হবে। আবার এই কথার পেছনেই লুকিয়ে থাকবে অন্য কথা। গোটা জাতির মধ্যে স্বস্তি এনে গত ১ নভেম্বর শুরু হয়েছে সংলাপ। সংলাপের শুরুটা কেমন হয়েছে, এটা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি। কিন্তু শেষটা না দেখে মন্তব্য করা মুশকিল।
আমি সবসময় আশাবাদী মানুষ। আমি কখনো অর্ধেক গ্লাস খালি বলি না। বরং আমি অর্ধেক গ্লাস পানিতে এবং বাকি অর্ধেক বাতাসে ভর্তি দেখি। সংলাপের গ্লাসও আমি ভর্তিই দেখছি।
১ নভেম্বরে সংলাপ শেষে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ঐক্যফ্রন্টের দলনেতা ড. কামাল হোসেন বলেছেন, `আলোচনা ভালো হয়েছে।’ তবে মির্জা ফখরুল বলেছেন, `আমরা সন্তুষ্ট নই।’ আর ওবায়দুল কাদের বলেছেন,`কিছু বিষয় আমরা একমত হয়েছি। তবে আলোচনা আরো হবে।’
ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যেই লুকিয়ে আছে সমাধানের সূত্র। পরে ড. কামাল হোসেনের বাসায় আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনেও আরো আলোচনার সম্ভাবনার কথা বলা হয়। যারা ভেবেছিলেন এক সংলাপেই মিটে যাবে সব সমস্যা; তারা হতাশ হয়েছেন। আমি বলবো, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
যুগ যুগ ধরে চলে আসা সমস্যা সাড়ে তিন ঘণ্টায় মিটে যাবে, এটা আশা করাই ভুল। দুপক্ষ যে মুখোমুখি বসেছে, এটাই বাংলাদেশের রাজনীতির এক বড় অগ্রগতি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সংলাপে বসেছিল ৭ দফা নিয়ে। আর সরকারি দলের শর্ত ছিল, সংবিধানসম্মত আলোচনা। দুপক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে অনড় ছিল।
প্রথম দিনের সংলাপে দুপক্ষ মুখোমুখি বসে আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে সাড়ে ৩ ঘণ্টা কথা বলেছে, এটাই সবচেয়ে বড় অগ্রগতি। আপনি যদি আমাকে প্রশ্ন করেন, সংলাপ কি সফল হয়েছে? আমি বলবো, না। সংলাপ কি ব্যর্থ হয়েছে? আমি তাও বলবো, না। আমি বলবো, সংলাপে সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে।
আমার ধারণা প্রথম দিনের সংলাপে দুপক্ষই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে। নিজেদের সব তাস খেলে ফেলেনি। আওয়ামী লীগও চায়, এবারের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হোক। আবার বিএনপিও এবার নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় নির্বাচনে যেতে চায়। তাই আমার ধারণা, দুপক্ষই আরো ছাড় দেবে। সংলাপের পর কোনো পক্ষই সমঝোতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়নি। প্রথম দিনেই সিদ্ধান্ত হয়েছে ছোট পরিসরে আরো আলোচনা হবে। ইতোমধ্যেই আবারো আলোচনার সময় চেয়ে সরকারি দলের কাছে চিঠি দিয়েছে।
দুপক্ষ যদি নিজ নিজ জায়গায় অনড় থাকে, তাহলে কেয়ামত পর্যন্ত সংলাপ হলেও সমাধান হবে না। তবে ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকলে ৭ দফাতেই সমাধান বের করা সম্ভব। প্রথম দিনেই প্রধানমন্ত্রী সভা-সমাবেশ করতে অনুমতি লাগবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। বিরোধী দলের ‘গায়েবি মামলা’র অভিযোগের জবাবে প্রধানমন্ত্রী তালিকা দিতে বলেছেন।
আমার ধারণা, ৭ দফার ৬টিই আংশিকভাবে মেনে নেয়া সম্ভব, সংলাপের পর্যায়ে হয়তো মেনে নেবেও। কিন্তু প্রথম দিনেই সবটুকু ছাড় দিলে কৌশলগতভাবে হেরে যাওয়ার ভয় থাকে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের কোনো সম্ভাবনা নেই, এটা সবাই জানেন। তবে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের দাবি মেনে নেয়া সম্ভব।
আরপিও সংশোধন করে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সুযোগ রাখলেও, এ ব্যাপারে সরকারেরও খুব বেশি আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। সরকার খুব বেশি অনড় হলে খুব সীমিত পরিসরে ইভিএম ব্যবহার হতে পারে। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগে কারোই আপত্তি থাকার কথা নয়।
আমার ধারণা নির্বাচনে সেনা মোতায়েনেও সরকারের খুব বেশি আপত্তি থাকবে না। তবে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়ার সম্ভাবনা নেই। মামলা প্রসঙ্গেও নির্বাচনের সময় সরকার সংযত থাকবে বলেই মনে হয়। মামলা যা দেয়ার সরকার দিয়ে দিয়েছে।
তবে মূল দাবি নিয়ে সরকার অনড় থাকবে বলেই আমার ধারণা। নির্বাচনের আগেই বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সংলাপের প্রথম দফায় সরকার পক্ষ খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আদালতের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। কাগজে-কলমে এটাই বাস্তবতা।
সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙ্গে দেয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই। নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের দাবি নিয়ে আলেচনা হতে পারে। এ ব্যাপারে সংবিধানের ভেতরে থেকেই একাধিক বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন ড. কামাল হোসেন। তবে আমার ধারণা সংবিধানের ভেতরে থেকেই ঐক্যফ্রন্টের কয়েকজনকে নির্বাচনকালীন সরকারে নেয়া সম্ভব।
সংসদ বহাল থাকবে, শেখ হাসিনা সরকার প্রধান থাকবেন, বেগম খালেদা জিয়া কারাগারেই থাকবেন- এই শর্তে ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপি যদি নির্বাচনে আসতে সম্মত হয়; তাহলেই জট খুলতে পারে। আন্দোলন করে দাবি আদায়ের পথে যেতে হবে- বলা হলেও সে সময় বা সক্ষমতা কোনোটাই ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপির আছে বলে মনে হয় না।
সংলাপে সমাধানের আগেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে জটিলতা বাড়তে পারে। এটা নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার। ঐক্যফ্রন্ট এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে তফসিল স্থগিত রাখতে অনুরোধ করেছে।
ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, তফসিল পেছালে তাদের আপত্তি নেই। ৪ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কথা ছিল। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নির্বাচন কমিশন সেটা চারদিন পিছিয়ে ৮ নভেম্বর করেছে। তার মানে সমস্যা সমাধানের জন্য হাতে সময় খুব বেশি নেই। যা করার দ্রুত করতে হবে।
আমি সবসময় আশাবাদী মানুষ। আমি কখনো অর্ধেক গ্লাস খালি বলি না। বরং আমি অর্ধেক গ্লাস পানিতে এবং বাকি অর্ধেক বাতাসে ভর্তি দেখি। সংলাপের গ্লাসও আমি ভর্তিই দেখছি।