মিয়ানমারে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ যখন কার্যত হিমশিম খাচ্ছে, তখন চলতি মাসেই কিন্তু ভারত থেকে রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরা শুরু হয়ে গেছে।
জাতিসংঘের আবেদন উপেক্ষা করেই গত ৪ অক্টোবর সাতজন রোহিঙ্গা যুবককে আসাম থেকে মিয়ানমারে পাঠানো হয়েছে। মিয়ানমারের কর্মকর্তারা তাদের গ্রহণও করেছেন, ব্যবস্থা করা হয়েছে মিয়ানমারে তাদের পরিচয়পত্রেরও। আরও অন্তত ৩০ জনকে দিনকয়েকের মধ্যেই ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন, মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকার নয়, বরং সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি সমঝোতা করেই ভারত এভাবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে পারছে।
অথচ প্রায় সোয়া বছর আগে ভারত সরকার যখন এদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় ও সেই মর্মে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামাও দেয়, তখন তাদের অঘোষিত পরিকল্পনা ছিল এই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর, কারণ তাদের বেশির ভাগই বাংলাদেশ হয়েই ভারতে ঢুকেছে।
গত অক্টোবর-নভেম্বরে যে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে শতাধিক রোহিঙ্গাকে পুশব্যাক করা হয়েছিল, সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের তখনকার প্রধান কে কে শর্মা নিজেই তা স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু মাত্র মাসতিনেক আগে সরকারের এই নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে।
জুলাইয়ের শেষদিকে পার্লামেন্টে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং ঘোষণা করেন, ‘রোহিঙ্গারা যাতে কোনোভাবেই ভারতের নাগরিকত্ব দাবি করতে না পারে, সে ব্যবস্থা যেমন নেয়া হচ্ছে, তেমনি তাদের মিয়ানমারে ডিপোর্ট করার জন্য ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও সে দেশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করছে।’
ভারত সেই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বলে যে রোহিঙ্গাদের তারা মিয়ানমারেই ফেরত পাঠাতে চায়। সেই অনুযায়ী মিয়ানমারের সঙ্গে পর্দার আড়ালে সমঝোতার চেষ্টাও শুরু হয়ে যায়, যা এখন দেখা যাচ্ছে সফল হয়েছে।
দিল্লিতে অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো জয়িতা ভট্টাচার্য মনে করেন, মিয়ানমার যে ভারত থেকে কিছু রোহিঙ্গাকে নিতে রাজি হয়েছে তার একটা কারণ তারা এই ইস্যুতে আর কোনঠাসা থাকতে চাইছে না।
তার কথায়, ‘এই রোহিঙ্গা সমস্যার জন্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মিয়ানমারের বন্ধুর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। সেখানে ভারতকে হারাতে যে তারা রাজি হবে না এটাই স্বাভাবিক, কারণ কূটনৈতিক দিক থেকে দেখতে গেলে তাদের এখন বন্ধুর দরকার। আর একটা জিনিস হল, এখনও অবধি খুব কম সংখ্যক রোহিঙ্গাকেই কিন্তু তারা ফেরত নিয়েছে। বাংলাদেশে যেখানে লাখো রোহিঙ্গা এখন বাস করছেন, সেখানে ভারত থেকে মাত্র সাতজনের ফেরত যাওয়াটা আসলে খুবই কম।’
কিন্তু ভারত এই সমঝোতাটা যে সরাসরি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে করেছে তা নিয়ে মোটামুটি নিশ্চিত বছরদুয়েক আগেও মিয়ানমারে ভারতের রাষ্ট্রদূত থাকা গৌতম মুখোপাধ্যায়।
বিবিসিকে তিনি বলেছেন, ‘এই ধরনের ইস্যুতে সেখানে এখনও সেনাবাহিনীই শেষ কথা বলে। আর তা ছাড়া জনমতও ভীষণভাবে তাদের সঙ্গে আছে, আর রাখাইনে তো জনমত ভীষণভাবেই রোহিঙ্গাবিরোধী। এই পরিস্থিতিতে গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের মতকে উপেক্ষা করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা একমাত্র মিলিটারিরই আছে এবং অং সান সু চির একেবারেই নেই। এটা মানুষ বুঝতে পারে না, যে তিনি আর যাই হোক গান্ধী নন।’
তবে মিয়ানমারের সঙ্গে ভারতের যা-ই সমঝোতা হোক, ইতোমধ্যেই জাতিসংঘ যাদের শরণার্থীর মর্যাদা দিয়েছে তাদের ফেরত পাঠানো খুব সহজ হবে না বলেই মনে করেন জয়িতা ভট্টাচার্য।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে সর্বশেষ অগ্রগতি হলো, আগামী নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছেন মিয়ানমারের পররাষ্ট্রসচিব মিন্ট থোয়ে।