২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ভোর ৫:১১

জোর যার, মুল্লুক তার!

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা কার? যারা যত বেশি মানুষকে জিম্মি করতে পারে, তাদের ক্ষমতাই সবচেয়ে বেশি। এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে পরিবহন শ্রমিকদের ক্ষমতাই সবচেয়ে বেশি। সংসদে পাস হওয়া আইন বাতিলের দাবিতে তারা সারাদেশ অচল করে দিয়েছে। তাদের দাবি শুনলে মনে হবে বাংলাদেশটা যেন মগের মুল্লুক।

এখানে জোর যার মুল্লুক তার। যার ব্ল্যাকমেইল করার ক্ষমতা বেশি, সেই ন্যায্য-অন্যায্য দাবি আদায় করতে পারবে। নির্বাচনের আগে আগে হলে তো কথাই নেই। তাদের ক্ষমতাই যে সবচেয়ে বেশি, এটা পরিবহন শ্রমিকরা জানেন। আর সেই ক্ষমতার যথেচ্ছ অপপ্রয়োগও করেন তারা। যখন-তখন এক ফোনে বন্ধ হয়ে যায় পরিবহনের চাকা। গোটা দেশ জিম্মি হয়ে যায়।

সরকার বার বার নমনীয় থেকে পরিবহন শ্রমিকদের পক্ষে রাখতে চায়। কিন্তু কয়েক লাখ পরিবহন শ্রমিককে পক্ষে রাখতে গিয়ে যে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, সেটাও আমলে নিতে হবে। আর সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। পরিবহন শ্রমিকদের দাবিগুলো অন্যায়, অন্যায্য। তাই তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতর ব্যবস্থা নিতে হবে।

বার বার তারা হঠাৎ ধর্মঘট ডেকে অন্যায় দাবিও আদায় করে নেয়। সস্পাদকদের ক্ষমতা কম। তারা মাত্র ১৬ জন মানববন্ধন করেছেন। তাতে কারো ভোগান্তি হয়নি। তাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সরকার অনড়। তবে সুখের কথা সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের সুযোগ নেই।

তবে পরিবহন শ্রমিকদের এই ক্ষমতার উৎসও কিন্তু আরেক মন্ত্রী- মহাপরাক্রমশালী শাজাহান খান। সড়ক পরিবহন আইন যখন অনুমোদন হয়, তখন শাজাহান খানও নিশ্চয়ই মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

সংসদে যেদিন আইনটি পাস হয়, সেদিন তিনিও নিশ্চয়ই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। শাজাহান খানও নিশ্চয়ই আইনটি পাশের পক্ষে হ্যাঁ ভোট দিয়েছেন। আর এখন তিনি তার বাহিনীকে উস্কানি দিয়ে মাঠে নামিয়ে দিয়েছেন। তারা অচল করে দিয়েছে সারাদেশ। অল্প কিছু পরিবহন শ্রমিকের হাতে জিস্মি কোটি কোটি মানুষ। কেউ রাস্তায় নামলে তার মুখে কালি মাখিয়ে দিচ্ছে।

সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনসহ ৮ দফা দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট ডেকেছে বাংলাদেশ পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। এই সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান। এই মন্ত্রী দায়িত্বে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু তার মূল আগ্রহ সড়ক পরিবহন নিয়ে। শুধু তাই নয়, গার্মেন্টস শ্রমিকরাও তার নিয়ন্ত্রণে।

এখন কোটা পুনর্বহালের আন্দোলনের দায়িত্বও নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন সব্যসাচী এই মন্ত্রী। তিনি যে সংগঠনের কার্যকরী সভাপতি, সে সংগঠনই ধর্মঘট ডেকেছে; অথচ তিনি বলছেন, ধর্মঘট নিয়ে তিনি কিছু জানেন না। এটা যে ডাহা মিথ্যা, তা দুধের শিশুও জানে।

বাংলাদেশের পরিবহন সেক্টরে শাজাহান খানের ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। এবার হয়তো চক্ষুলজ্জা আর প্রবল সমালোচনা এড়াতে নিজেকে আড়ালে রেখেছেন তিনি। কারণ এর আগে আমরা দেখেছি, শাজাহান খানের বাসা থেকে ধর্মঘটের ডাক এসেছে। আচ্ছা ধরে নিচ্ছি শাজাহান খান সত্যিই ধর্মঘট সম্পর্কে কিছু জানেন না। এখন তো জানছেন। এখন আপনার বাহিনীকে থামান।

সড়ক দুর্ঘটনায় দুই সহপাঠীর মৃত্যুর পর গত ২৯ জুলাই নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলন সরকারকে সুযোগ করে দিয়েছিল সড়ক পরিবহন আইন পাসের। জন আকাঙ্খা পুরোপুরি প্রতিফলিত না হলেও আগের চেয়ে কিছুটা কঠোর করে গত ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে পাস হয় সড়ক পরিবহন আইন।

সড়ক দুর্ঘটনায় হত্যার সর্বোচ্চ সাজা ছিল ৩ বছর কারাদণ্ড। নতুন আইনে তা বাড়িয়ে ৫ বছর করা হয়েছিল। অথচ ১৯৮৩ সালের আইনেও সড়ক দুর্ঘটনার সর্বোচ্চ সাজা ছিল ১০ বছর কারাদণ্ড। তবে নতুন আইনে ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত সাজার সুযোগ রয়েছে। এখন পরিবহন শ্রমিকরা নতুন আইন সংশোধনের দাবিতে ধর্মঘট করছে। অথচ শিক্ষার্থী ও নাগরিক সমাজের দাবি ছিল আরো কঠোর আইনের।

চালকরা যদি নিয়ম মেনে লাইসেন্স নেন, সাবধানে গাড়ি চালান, তাহলে তো তাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু তারা রাজপথকে মরণফাঁদ বানিয়ে ফেলবেন, আর তাদের কিছু বলা যাবে না, এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। অপরাধী না হলে কঠোর আইনে ভয়ের কিছু নেই।

কেউ যদি ন্যায্য দাবি করে, তিনি একজন হলেও আমরা তার পাশে আছি। আমরা দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর অনশনের কারণে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এখনও ডাকসু নির্বাচন হয়নি, তবে সবাই এ দাবির যৌক্তিকতা মেনে নিয়েছেন।

কদিন আগে আরেক শিক্ষার্থীর অনশনে বাতিল হয়ে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দাবি করা, আন্দোলন করা, অনশন করা, ধর্মঘট করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু অন্যায় দাবি আদায়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করার অধিকার কারো নেই, থাকা উচিত নয়।

সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা মানুষকে কথা বলতে দেয় না, আন্দোলন করতে দেয় না। মামলা-হামলায় দমন করে বিরোধী মতকে। এই অভিযোগের একটা বাস্তব প্রতিফলন চাই। চাই সরকার কঠোরভাবে পরিবহন শ্রমিকদের দমন করুক।

সরকার বার বার নমনীয় থেকে পরিবহন শ্রমিকদের পক্ষে রাখতে চায়। কিন্তু কয়েক লাখ পরিবহন শ্রমিককে পক্ষে রাখতে গিয়ে যে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, সেটাও আমলে নিতে হবে। আর সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। পরিবহন শ্রমিকদের দাবিগুলো অন্যায়, অন্যায্য। তাই তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতর ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রকাশ :অক্টোবর ২৯, ২০১৮ ৪:১৪ অপরাহ্ণ