নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক ডামাডোলের ফাঁকে অর্থপাচার বেড়েছে বলে গুঞ্জন তুঙ্গে। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে বাংলাদেশে ঢোকার গুঞ্জন-গুজবও কম নয়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা না-কি এ সংক্রান্ত কিছু তথ্যসাবুদও পেয়েছে। কিন্তু নির্বাচনী এ অর্থসংযোগের মূলে হাত দেয়া কি অসাধ্য?
দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের এক্ষেত্রে চট জলদি করার কিছু নেই। তারা রাজস্ব ফাঁকি ও দুর্নীতির নানা অভিযোগে দাবড়ানো শুরু করেছে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের। কোথাও জমি-জিরাত কেনা বা নতুন বিনিয়োগ করলেই জানতে চাওয়া হচ্ছে অর্থের উৎস সম্পর্কে। তলব করে ডেকেও নেয়া হচ্ছে।
এনবিআর, দুদক ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, মুদ্রা পাচার এবং রাজস্ব ফাঁকিসহ নানা অভিযোগে নাস্তানাবুদ করা হচ্ছে তাদের। এ ধরনের কয়েকটি ঘটনায় বিজনেস কমিউনিটিতে ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ চলছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্তের শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নির্বাচনের আগে-পরে বরাবরই অর্থনীতির গতিপ্রবাহ অনেকাংশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আগামী নির্বাচন কেমন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নাকি অন্য কোনো সরকার ব্যবস্থায়? ভাঙা-গড়ার রাজনীতিতে দল-জোটগুলোর ভূমিকা কী হবে, বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেবে, নাকি কারাবন্দি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি তুলে আন্দোলন চাঙা করবে-এসব ভাবনা শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনের নয়।
অন্যান্য কমিউনিটির মতো ব্যবসায়ীদেরও মাঝেও এ নিয়ে ব্যবসায়িক হিসাব-নিকাশ থাকা স্বাভাবিক। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন ও ক্ষমতার পালাবদল তাদের জন্যও স্বস্তিকর। নইলে রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক শঙ্কাও স্বাভাবিক।
এ বাস্তবতার মধ্যে ব্যবসায়ীদের বিশেষভাবে দোষী সাব্যস্ত বা সন্দেহের আওতায় ফেলে গোটা অর্থনীতিকে বিপাকে ফেলা হচ্ছে কি-না ভাবনার অবকাশ রয়েছে। বহুল আলোচিত ওয়ান ইলেভেন মৌসুমে ব্যবসায়ীদের গণহারে ধরপাকড় ও কলঙ্কিত করার পরিণতি অর্থনীতির জন্য ভালো হয়নি। কালো টাকা উদ্ধারের নামে অর্থ হাতানোর সেই ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকে।
ব্যবসায়ী মানেই লুটেরা, কালোবাজারি-এমন একটি প্রচারণা ও অ্যাকশনের জের সইতে হয়েছে অনেকদিন। ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার সেই ক্ষত সারানোর চেষ্টা কম করেনি। নানা পদক্ষেপে ব্যবসা-বাণিজ্য সেক্টরকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলেছে। অর্জনও একটু একটু করে মন্দ হয়নি। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে আবার রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার পরিণামে প্যাঁচিয়ে যায় অর্থনৈতিক খাত। বিনিয়োগে এক পা এগিয়ে তিন পা পিছিয়ে যেতে হয় ব্যবসায়ীদের। তাদের অস্বস্তি-অনিশ্চয়তার সেই পথযাত্রা এখনো শেষ হয়নি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতায় মাত্র আড়াই মাসে দেশের উৎপাদন ঘাটতি হয়েছে চার হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খাতওয়ারি ঘাটতির পরিমাণ তৈরি পোশাক খাতে ১৩১৮ কোটি টাকা, চিংড়ি ও হিমায়িত খাদ্যে ৭৪১ কোটি, কৃষিতে ৩৯৮ কোটি, পোল্ট্রি খাতে ৬০৬ কোটি, প্লাস্টিক খাতে ২৪৪ কোটি, পর্যটনে ৮২৫ কোটি, ব্যাংক ও বীমা খাতে ১৫৬ কোটি, পরিবহন খাতে ৭৪৪ কোটি এবং পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায় ৪৪৮ কোটি টাকা।
নির্বাচন সামনে রেখে আবারো ভর করেছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। হরতাল-ধর্মঘট, জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো বিধ্বংসী কর্মসূচি না থাকলেও ব্যবসায়ী সম্প্রদায় উদ্বেগে আক্রান্ত। যা থেকে বাদ পড়ে না সাধারণ ভোক্তারাও। এদিকে জলবায়ু পরিবর্তন এবং চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোয় বড় ধরনের আর্থিক ঝুঁকি ও সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার বালির নুসাদুয়া কনভেনশন সেন্টারে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক বৈঠকেও এ সংকটের আভাস পাওয়া গেছে। বৈঠকে বিশ্ব অর্থনীতি পর্যালোচনায় উঠে আসে মার্কিন ডলারের দাম স্থিতিশীল থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি। বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোও এ সংকটের শিকার হতে পারে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়লেও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে গেছে। বেড়েছে সরকারি খাতে। রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধির হার কমে গেছে। বৈদেশিক বিনিয়োগেও চলছে মন্দাভাব। নির্বাচনী অর্থনীতির এ গতি কোন মাত্রায় গিয়ে ঠেকবে এখনই বলা যাচ্ছে না।
স্বাভাবিক চিন্তায় যে কেউই বুঝতে পারছেন, নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের বাড়তি খরচ মেটাতে বাজারে ব্যাংকবহির্ভূত টাকার প্রবাহ বাড়বে। সেখানে যোগ হতে পারে কালো টাকাও। এতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা বোধ করছেন অনেকেই। এ রকম শঙ্কাজনক অবস্থার মধ্যে ব্যবসায়ীদের ওপর অনাকাঙ্খিত পীড়ন অর্থনীতির পাশাপাশি সামাজিক স্থিতিতেও ছেদ ফেলতে পারে।
টাকা পাচার বা অর্থনৈতিক অনৈতিক বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকলে ধরপাকড়সহ ব্যবস্থা নেয়াই যেতে পারে। তা না করে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন দফতর বা সংস্থায় ডাকাডাকি কি আদৌ কোনো সুফল আনবে? দেশে ধনাঢ্যের সংখ্যা বেড়েছে-তা বুঝতে দলিল-দস্তাবেজ দরকার পড়ে না। আলামতেই তা পরিষ্কার। আবার তা দোষণীয়ও নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্সের ‘ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট ২০১৮’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন ব্যাপক হারে ধনকুবের সৃষ্টি করছে। প্রতিবেদন বলছে, ‘এটা আশ্চর্যজনক যে ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক থেকে চীন বিশ্বের এক নম্বর দেশ নয়। এ অবস্থান বাংলাদেশের।
২০১২ সাল থেকে শুরু করে, গত পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারতসহ ৭৫টি বড় অর্থনীতির দেশের চেয়েও বাংলাদেশ বেশি ধনী মানুষ উৎপাদন করেছে। এ সময়ে দেশে ধনী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে গড়েছে ১৭ শতাংশেরও বেশি হারে, অথচ সারা বিশ্বে যার গড় প্রবৃদ্ধি ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। বিবিএসের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১৬ প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ৪ কোটি মানুষ আজও দরিদ্র এবং ২ কোটিরও বেশি মানুষ আজও হতদরিদ্র। শতকরা হিসাবে যথাক্রমে ২৪.৩ শতাংশ ও ১২.৯ শতাংশ।
এ ধরনের খবর বা তথ্য আনন্দের, না দুঃখের? লজ্জার, না গর্বের? আশার না হতাশার? থাকতেই পারে এ ধরনের প্রশ্নমালা। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটছে। এটা প্রচণ্ড আনন্দের। এভাবে ধনকুবের বাড়তে থাকলে দেশের উপকার হবে, না ক্ষতি হবে-সেই আলোচনাও হতে পারে। ধনাঢ্য হবার এ গতিপ্রবাহে গলদ থাকলে শুধরানো বা অ্যাকশন নিতেও দোষ নেই। নির্বাচন মৌসুমে এ ধনাঢ্যদের তৎপরতাও অস্বাভাবিক নয়। তাই বলে শুধু ব্যবসায়ীদের শনাক্ত করার মানে কী দাঁড়ায়?
বলা হচ্ছে, পাচারের অর্থে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করা এবং কানাডায় বেগম পাড়া তৈরিতে এগিয়ে বাংলাদেশিরা। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মধ্যে ইংলিশ চ্যানেলের ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতেও অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। পাচারের টাকা যাচ্ছে বিদেশের নামিদামি ক্যাসিনোতে। আর এসব অর্থ পাচারকারীকে দেখানো হচ্ছে ঋণখেলাপি হিসেবে।
দেশের অন্যতম আর্থিক কেলেঙ্কারিগুলোর মধ্যে একটি হলো শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি। এর পরে রয়েছে, একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট। হলমার্ক, বেসিক ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংগুলোতে একের পর এক কেলেঙ্কারি। দেশ থেকে অর্থ পাচার ও সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভের অর্থ চুরি। ২০০৮ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত আট বছরে দেশ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় লুট হয়েছে ১০ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশে পাচার হয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। পানামা ও প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারিতে যাদের নাম এসেছে, তাদের অনেকে নির্বাচন সামনে রেখে আবার অর্থপাচারে ঝাপিয়ে পড়েছে বলে প্রচারণা রয়েছে।
এ প্রচারণা সত্য হলেও কি ব্যবসায়ীরাই টার্গেট হবেন? কে না জানে, এসব পেপার্স ও কেলঙ্কারিতে এসেছিল কাদের নাম? কম-বেশি অনেকেরই জানা রাষ্ট্রীয় কোষাগার, ব্যাংক, বীমা লুট, বড় বড় কাজের কমিশন বাণিজ্যে কারা জড়িত? তাদের মধ্যে কারা ব্যবসায়ী আর কারা রাজনীতির দোকানদার সেই হিসাব বের করা খুব কঠিন কাজ নয়। অন্তত ব্যবসায়ীদের ডাকাডাকি বা উৎপীড়নের চেয়ে সহজ কাজ।
-মোস্তফা কামাল