এ কূল ভাঙে, ও কূল গড়ে; এই তো নদীর খেলা… নদীমাতৃক বাংলাদেশের খুব পরিচিত প্রবচন এটি। আমরা জীবনের নানা ক্ষেত্রে এই প্রবচনটি ব্যবহার করি। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় এই প্রবচনটি আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। যেন- এ দল ভাঙে, ও দল গড়ে; এই তো জোটের খেলা।
দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। তবে প্রথমে এই জোটটি ছিল চারদলীয়। পরে প্রথমে বড় হয়ে ১৮ দলীয়, পরে চূড়ান্ত হয় ২০ দলীয় জোটে। তবে এখন এই জোটে কয়টি দল আছে, তা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ ২০১৫ সালে ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যায় ন্যাশনাল পিপলস পার্টি- এনপিপি, পরের বছর বের হয় ইসলামী ঐক্যজোট। বাস্তবে সংখ্যা যাই হোক, জোটের নাম ২০ দলীয় জোটই থেকে যায়।
জোটবদ্ধ নির্বাচন আসলে ছোট দলগুলোর জন্য এক ধরনের জুয়া। সবার চেষ্টা থাকে বড় দান মারার। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অনেকেই লটারি জিতে এমপি হয়ে গেছেন। যেমন ঢাকার গুলশানের এমপি বিএনএফ’এর আবুল কালাম আজাদ। তিনি নিজেও কি কোনোদিন ভেবেছিলেন এমপি হবেন? এমন অনেক ওয়ানটাইম হঠাৎ এমপি আছেন দশম সংসদে।
কিন্তু এতদিনের পুরোনো জোট দিয়ে চলছিল না। সরকার বিরোধী বৃহত্তর নানা ঐক্য প্রক্রিয়ার দিকে লোভাতুর দৃষ্টি ছিল বিএনপির। বি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট আর ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া যখন বৃহত্তর ঐক্য গড়ার উদোগ নেয়, বিএনপিও তাতে জুটে যায়। কিন্তু বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হওয়ার আগেই ভেঙ্গে যায় যুক্তফ্রন্ট।
বিকল্পধারাকে একা রেখে জেএসডি আর নাগরিক ঐক্য যোগ দেয় ড. কামালের সাথে। গঠিত হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তাতে যুক্ত হয় বিএনপিও। আর বিএনপি ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত হওয়ায় ভাঙ্গনের সুর ২০ দলীয় জোটে। ১/১১এর কুশীলব, মাইনাস টু ফরমুলা বাস্তবায়নকারীদের সাথে যুক্ত হয়ে বিএনপি নৈতিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়েছে, দাবি করে ২০ দলীয় জোট ছেড়েছে বাংলাদেশ ন্যাপ ও এনডিপি। তারা যুক্ত হয়েছে বি চৌধুরীর যুক্তফ্রন্টে। এদিকে বাংলাদেশ ন্যাপ এবং এনডিপিও ভেঙ্গেছে। তাদের টুকরা রয়ে গেছে ২০ দলীয় জোটে। এদিকে ভেঙ্গেছে বিকল্পধারাও। আমাদের শঙ্কা নির্বাচনের আগে এই ভাঙ্গাগড়ার খেলা চলবে।
দল ভাঙ্গাগড়ার এই খেলায় সবাই অনেক বড় বড় আদর্শের কথা বলেন। যেমন বি চৌধুরী বলছেন, বিএনপি জামায়াতকে ছেড়ে আসেনি তাই তারা ঐক্যফ্রন্টে যাননি। কিন্তু বিকল্পধারার হঠাৎ এই জামায়াতবিরোধী হয়ে ওঠাটা রহস্যজনক। কারণ বি চৌধুরী বিএনপিতে থাকার সময়ই জামায়াতের সাথে তাদের জোট হয়েছিল। তখন কিন্তু তিনি প্রতিবাদ করেননি বা দল ছাড়েননি।
আবার বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) মান্নানের একাত্তরের ভূমিকাও কিন্তু সমালোচিত। নিজের ঘরে স্বাধীনতাবিরোধী রেখে জামায়াতের বিরুদ্ধে বিপ্লবকে ঠিক আদর্শিক মনে হয় না। ড. কামাল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জোট করেছেন। কিন্তু কাদের সাথে নিয়ে করেছেন? যে দলের চেয়ারপারসন দুর্নীতি মামলায় কারাগারে, যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত; সে দলের সাথে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই হাস্যকর শোনায়।
আর ১/১১ সরকারে বিরাজনীতিকরণের কুশীলবের সাথে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম দেখলেও বোঝা যায় এ জোটও আদর্শিক নয়। আসল কথা হলো ক্ষমতায় যাওয়া বা অন্তত ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়া। আদর্শের কোনো বালাই নেই। নির্বাচন সামনে এলেই রাজনীতিতে নানা মেরুকরণ হয়। ছোট দলগুলো বেশি অস্থির হয়ে যায়। কোথায় গেলে বেশি লাভ হবে, তা নিয়েই চলে হিসাব-নিকাশ, দর কষাকষি।
জোটবদ্ধ নির্বাচন আসলে ছোট দলগুলোর জন্য এক ধরনের জুয়া। সবার চেষ্টা থাকে বড় দান মারার। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অনেকেই লটারি জিতে এমপি হয়ে গেছেন। যেমন ঢাকার গুলশানের এমপি বিএনএফ’এর আবুল কালাম আজাদ। তিনি নিজেও কি কোনোদিন ভেবেছিলেন এমপি হবেন? এমন অনেক ওয়ানটাইম হঠাৎ এমপি আছেন দশম সংসদে।
একাদশ সংসদে এই সুযোগ নিতেই অনেকের হঠাৎ বিপ্লবী হয়ে ওঠা। যেমন বাংলাদেশ ন্যাপ ও এনডিপি নেতারা হয়তো বুঝতে পেরেছেন, বিএনপির সুযোগ কম। আর ঐক্যফ্রন্টের কারণে জোটে তাদের গুরুত্ব বা বার্গেইন পাওয়ার আরো কমে যাবে। তাই দ্রুত জোট ছেড়েছেন তারা। সরাসরি সরকারের সাথে যোগ না দিলেও তারা গেছেন যুক্তফ্রন্টে।
সব দেখেশুনে কারো বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, যুক্তফ্রন্টের সাথে সরকারের একটা গোপন যোগাযোগ আছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর নানাকিছু করে এখন আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হওয়ার ব্যাকুল চেষ্টা করছেন। সারাজীবন বিএনপির আদর্শ ধারণ করা নাজমুল হুদা কিভাবে বিপরীত মেরুর আওয়ামী লীগের সাথে যেতে পারেন? এখানে আদর্শের জায়গা কোথায়?
শোনা যাচ্ছে, গুলশান থেকে মজাজোটের মনোনয়ন চান ব্যারিস্টার হুদা। এই যে আওয়ামী লীগের সাথে মহাজোটে আছে জাতীয় পার্টি। এই দুই দলের আদর্শে কিন্তু আকাশ-পাতাল ফারাক। ৫ বছর আগে যারা সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্য নিয়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়েছিল, সেই হেফাজত এখনও আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ।
নির্বাচনের আগে এমন ভাঙচুর, ডিগবাজি-পাল্টা ডিগবাজি, জুয়ার দান বা মনোনয়নের লটারি জেতার নানা কসরত চলবে। দয়া করে কেউ এখানে আদর্শ খুঁজতে যাবেন না। এ নিছকই ক্ষমতায় থাকার, ক্ষমতায় যাওয়ার বা অন্তত ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার নির্লজ্জ চেষ্টা।