হজব্রত পালনের সময় আমরা তখন সৌদি আরবের মদিনায় অবস্থান করছিলাম। একদিন বিকেলে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ হলো ময়দান সালেহ এলাকার একটি ঐতিহাসিক রেলস্টেশন জাদুঘরে। প্রায় ১০০ বছর বন্ধ ছিল রেলস্টেশনটি। কয়েক বছর আগে বন্ধ স্টেশনটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। এখন দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত।
সেদিন ভেতরে ঢুকেই মনে হলো, এ যেন একপ্রস্থ ইতিহাসের স্মারক। বিশাল জায়গাজুড়ে প্ল্যাটফর্ম। আঁকাবাঁকা রেললাইন চলে গেছে অনেকটা দূর পর্যন্ত। আমরা সেই রেললাইন ধরে এগোতে থাকি। খানিকটা দূরে আসার পর দেখা মিলল, ট্রেনের কিছু বগি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পুরোনো বগিগুলো মেরামতের পর রং করা হয়েছে। চাইলে এসব বগির ভেতরটা ঘুরে দেখা যায়। সে জন্য বগির দরজায় কাঠের সিঁড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। উৎসাহী অনেক পর্যটককে দেখলাম ভেতরটাও ঘুরে দেখছেন।
ওই একই পথ ধরে আমরা আরও খানিকটা এগিয়ে যাই। তখন নজর কাড়ল সবুজ ঘাসের চত্বর। এ যেন মরুর বুকে সবুজের চাদর। দুদণ্ড প্রশান্তির জন্য সেখানে কেউ কেউ বসেও আছেন। অনেকে এসেছেন পরিবারের ছোট সদস্যদের নিয়ে। ঘাসের ওপর শিশুরা ইচ্ছেমতো খেলা করছে। অভিভাবকেরা খোশগল্পে সময় কাটাচ্ছেন। তবে এরপরের পর্বের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।
‘দেশি’ আপ্যায়ন
হেজাজ রেলস্টেশনের ভেতরেই রয়েছে সারি সারি খেজুরগাছ। সেসব গাছে থোকা থোকা কাঁচা-আধপাকা-পাকা খেজুর যেন জিবে জল আনে। সৌদি আরবে এসে খেজুর না খাওয়াটা অস্বাভাবিক ঘটনা, তবে গাছ থেকে পেড়ে খাওয়ার সুযোগ অনেকের ভাগ্যে হয় না। পেশাগত কাজে বেশ কয়েকবার এই মরুর দেশে আসার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু গাছ থেকে খেজুর খাওয়ার সৌভাগ্য আমারও হয়নি। তাই মনে মনে চাচ্ছিলাম, যদি খেজুর পেড়ে খাওয়া যেত!
ঠিক তখনই ঘটনাটি ঘটল। সৌদি আরবের আনাচকানাচে বাংলাদেশি মানুষের দেখা মেলে। নানা পেশায় তাঁরা জড়িয়ে আছেন। তাই বলে এমন এক জাদুঘরের উদ্যানে এসে বাংলাদেশি মানুষ পাব ভাবিনি। এখানে খেজুরগাছের পরিচর্যার দায়িত্বে যাঁরা, তাঁদের অনেকেই প্রবাসী বাংলাদেশি। আলাপ শুরু হলো, ‘দেশি, কেমন আছেন?’ বলে। বাংলাদেশি নতুন কোনো মানুষের সঙ্গে দেখা হলে সম্বোধনে ‘দেশি’ শব্দটা খুবই প্রচলিত এখানে। জানা গেল তাঁদের বাড়ি হবিগঞ্জের লাখাই এলাকায়। নামধাম সবই জানা হলো। আলাপে আলাপে তাঁরা জানালেন, দেশে তাঁদের পরিবার জানে, তাঁরা মদিনায় ভালো কাজ করেন। খেজুরগাছের পরিচর্যাকারী—এ পরিচয় অজানা।
যাক সেসব কথা। আলাপের ফাঁকে তাঁরা আমন্ত্রণ জানালেন, ‘অনেক তো খেজুর খেয়েছেন, এবার গাছ থেকে নিজ হাতে পেড়ে খেজুর খান। আর শুনুন, চাইলে কিছু নিয়েও যেতে পারেন।’
এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! আমন্ত্রণ পেয়ে সঙ্গী মওদুদ হাসানকে নিয়ে গাছ থেকে খেজুর পেড়ে খেলাম। খেজুরগাছগুলো বেশি বড় না। কিন্তু গাছভরা খেজুর। গাছের উচ্চতাও খুব বেশি নয়। চেয়ারে দাঁড়িয়েই কিছু খেজুর পেটে চালান করে দিলাম। খেজুরগুলো এত পাকা আর রসাল যে একটি পাড়তে গেলে অনেকগুলো খেজুর নিচে পড়ে যায়। আমার হাত লাগলে সবুজ ঘাসের ওপর টপাটপ খেজুর নিচে পড়ল। সঙ্গী মওদুদ খেজুর কুড়ালেন আর খেলেন!
অনেকগুলো খেজুর খাওয়ার পর মওদুদ বললেন, ‘খেজুর তো ধুইলাম না। খেলাম যে।’ তাঁর সন্দেহ দূর করতে খেজুরগাছ পরিচর্যাকারীদের একজন মজা করে বললেন, ‘গাছের খেজুর ধোয়াই থাকে!’
স্মৃতির সন্ধানে
অটোমান সাম্রাজ্যের (১২৯৯-১৯২৩) শেষ সময়ে জার্মান প্রযুক্তি ব্যবহার করে তুর্কিরা মদিনার এই রেলস্টেশন নির্মাণ করেছিল। তৎকালীন সময়ে এটা ছিল অর্থনৈতিক ও প্রকৌশলগত বড় চ্যালেঞ্জ। বাজেট ছিল ১৬ মিলিয়ন ডলার। এই প্রকল্পে ৫ হাজার তুর্কি সৈন্য নিয়োজিত ছিল।
পূর্বপুরুষদের স্মৃতির সন্ধানে রেলওয়ে জাদুঘরের দর্শনার্থীদের তালিকায় তাই তুরস্কের নাগরিকদের সংখ্যা কিছুটা বেশি। সেদিন যেমন পরিচয় হলো তুরস্কের আইসে সুলতানার সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে হেজাজ নিয়ে বেশ গল্প জমে গেল। পুরো ইতিহাস যেন তাঁর নখদর্পণে। আমরা তাঁর ইতিহাস বয়ানে কান পাতি।
১৯০৮ সালের ২৩ আগস্ট অটোমান শাসক আবদুল হামেদ আনুষ্ঠানিকভাবে রেললাইন চালু করেন। রেললাইনের বিস্তৃতি ছিল সিরিয়ার দামেস্ক শহর থেকে সৌদি আরবের মদিনা পর্যন্ত। এই পথে জর্ডানের আম্মান শহর ছুঁয়ে ট্রেন আসত মদিনায়। মূলত, সে সময়ে ইরাক বা সিরিয়া থেকে হজব্রত পালন করতে আসা সহজ এবং নিরাপদ করাই ছিল এই রেললাইনের উদ্দেশ্য। যেমন ট্রেন চালুর আগে সিরিয়ার দামেস্ক থেকে মদিনায় আসতে সময় লাগত ৪৫ দিন, চালুর পর তা কমে আসে মাত্র ৫ দিনে। তা ছাড়া দীর্ঘ যাত্রায় দস্যুরা হজযাত্রীদের সম্পদ লুণ্ঠন করত। ট্রেন চালু হওয়ার ফলে হজযাত্রীরা নিরাপদে পৌঁছাতেন।
আইসে সুলতানা জানালেন, মদিনা স্টেশনের উদ্বোধনের পর হেজাজের সঙ্গে আরব বিশ্বের বাকি অংশের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগের এক নতুন দিক উন্মোচিত হয়। প্রথম বছর ত্রিশ হাজার যাত্রী পরিবহন করা হয় এবং পরবর্তী ছয় বছরের মাথায় বেড়ে দাঁড়ায় বছরে তিন লাখে।
তাঁর কথায় আরও ইতিহাস উঠে এল। সে ইতিহাস ঐতিহাসিক এই রেলপথ বন্ধ হওয়ার করুণ ইতিহাস।
১৯১৪ সাল। প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলো। প্রথম মহাযুদ্ধে তুরস্ক অক্ষশক্তির পক্ষে ছিল। স্বভাবতই ইংরেজরা সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করে তুর্কি সাম্রাজ্য ফাটল ধরানোর। সফলও হলো। ইংরেজদের প্রলোভিত প্রস্তাবে সাড়া দেন মক্কার আমির শরিফ হোসাইন বিন আলী (১৮৫৪-১৯৩১)। আগেই বলেছি, হেজাজ রেলওয়ে ছিল উসমানীয় রেলওয়ে নেটওয়ার্কের একটি অংশ। ইস্তাম্বুল থেকে দামেস্ক হয়ে মক্কা পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য এটি নির্মাণ করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে মদিনার এর বেশি নির্মাণ সম্ভব হয়নি।
১৯২০ সালে হঠাৎই বন্ধ হয় হেজাজ রেলওয়ে। তারপর নানান কারণে রেলস্টেশনটি সৌদি সরকারও চালু করেনি। এখন তো ঐতিহ্য হিসেবে হেজাজ রেলস্টেশনকে জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ইতিহাসের পথে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের সময় ফুরিয়ে যায়। আইসে সুলতানাও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুখে হাসি ফোটান। আমরা বিদায় নিই হেজাজের ইতিহাস বুকে চেপে।