অর্থনীতি ডেস্ক:
মাস ছয়েক আগেও আন্তঃ ব্যাংক মুদ্রাবাজারে (কলমানি মার্কেটে) ১০০ টাকা খাটালে পাওয়া যেত ৪ টাকা। গতকাল তা নেমে এসেছে ১৫ পয়সায়। হঠাৎ নাই নাই-এর মধ্যে কলমানি মার্কেটের এমন অবস্থার পেছনে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতকে আশীর্বাদ বলে মনে করছেন বেশির ভাগ ব্যাংকার। কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক স্বস্তির ঢেঁকুর তুলে বলেন, আমরা দেশের মোট বিনিয়োগে ৭০ শতাংশ আবদান রাখলেও সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত পেতাম ২৫ শতাংশ। আর বিনিয়োগের ৩০ শতাংশ অবদান রেখে সরকারি ব্যাংকগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত পেত ৭৫ শতাংশ। ফলে সরকারি ৫ ব্যাংকের কাছে সবসময় উদ্বৃত্ত তারল্য থাকত, যার মাধ্যমে পুরো কলমানি মার্কেট নিয়ন্ত্রণ হতো। বর্তমানে এ অবস্থার অবসান হচ্ছে। ৫০ শতাংশ সরকারি আমানত বেসরকারি ব্যাংকে আসায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নগদ টাকার সঙ্কট কেটে যাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে কলমানি মার্কেটে।
জানা গেছে, ফারমার্স ব্যাংকের ঋণজালিয়াতির পর সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি ব্যাংক থেকে আমানত প্রত্যাহার করতে থাকে। এতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করে। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংক পরিচালকদের চাপে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখতে বাধ্য করা হয়েছে। ফলে সরকারি ব্যাংক থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আবার আমানত তুলে নিয়ে বেসরকারি ব্যাংকে রাখছে। এতে তাদের নগদ টাকার সঙ্কট কেটে যাচ্ছে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ ও আমানতের অনুপাত ৮৫ শতাংশ থেকে সাড়ে ৮৩ শতাংশে নামিয়ে এনেছে, যা আগে কোনো কোনো ব্যাংকের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশে উঠে গিয়েছিল। এতে ব্যাংকগুলোর হাতে নগদ টাকার প্রবাহ বেড়ে গেছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে কলমানি মার্কেটে।
তবে কলমানি মার্কেটে সুদহার কমলেও ঋণের সুদহার কমাতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এর কারণ হিসেবে কয়েকট ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, সরকারি আমানত ৫০ শতাংশ পেলেও তা ৬ শতাংশে পাওয়া যাচ্ছে না। এখন সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত পেতে ক্ষেত্রবিশেষ সাড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশ ব্যয় করতে হচ্ছে। ৯ শতাংশের সাথে পরিচালনব্যয় যোগ করলে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় ১২ শতাংশে উঠে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতে ৯ শতাংশে ঋণ দেয়া তাদের পক্ষে মোটেও সম্ভব হবে না। তবে কলমানি মার্কেটে ১৫ পয়সা খাটিয়ে লোকসান সমন্বয় করছেন কিভাবে- এমন এক প্রশ্নের জবাবে একজন তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, ঋণ আমানতের অনুপাত সমন্বয় করার পর তাদের হাতে সামান্য অলস টাকা থাকছে। আর এ অবস্থা প্রায় প্রতিটি ব্যাংকেরই। ফলে যে লোকসান হচ্ছে তা সমন্বয় হয় অন্য ঋণের সুদ ও সার্ভিস চার্জের মাধ্যমে।
এ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিন কারণে ব্যাংকিং খাতে তারল্য চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ে সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতে আমানতের তুলনায় ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে। আমদানিনির্ভর দ্রুত ঋণপ্রবৃদ্ধির সাথে রফতানি ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির পার্থক্য বেশি হয়েছে। এতে স্থানীয় বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও জোগানের মধ্যে অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়েছে। এর পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংকের আর্থিক অনিয়নের জন্য ব্যাংকিং খাতে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি উদ্ভব হয়েছে। সব মিলে ব্যাংকিং খাতে তারল্য ব্যবস্থাপনায় চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
তারল্য ব্যবস্থাপনায় এ চাপ সামলাতে বাংলাদেশ ব্যাংকেরও বেগ পেতে হয়েছে। ব্যাংকগুলো যাতে সহজেই টাকার সঙ্কট মেটাতে পারে এ জন্য রেপোর সুদহার শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ কমাতে হয়েছে। ব্যাংকারদের চাপে কমানোর হয়েছে সিআরআর হার। বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ২৩১ কোটি ডলার ছাড়তে হয়েছে। আর ফারমার্স ব্যাংকের অনিয়মের দায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সরকারি ৫ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর। এসব প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করা হয়েছে আর্থিক অনিয়মের কারণে সঙ্কটে পড়া ফারমার্স ব্যাংকের মূলধন জোগান দিতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবিবেচনামূলক আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে অর্থবছরের দ্বিতায়ার্ধে কিছু তফসিলি ব্যাংকের তারল্য চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। এ তারল্য চাপ কমাতে ঋণ আমানতের সর্বোচ্চ সীমা অর্থাৎ সাড়ে ৮৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে আগামী বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
এ দিকে, নতুন প্রজন্মের ব্যাংক ফারমার্সের আর্থিক অনিয়মের ফলে ওই ব্যাংকে উদ্ভূত তারল্য সঙ্কট সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতের আমানতকারীদের মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি করেছিল। এ অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে স্বস্তিকর অবস্থায় ফিরে আনতে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে ব্যাংকটিতে নতুন করে মূলধন জোগান দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে ব্যাংকিং খাতের ওপর আমানতকারীদের আস্থা ফিরে আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অপর দিকে ব্যাংকগুলো তহবিলের ব্যবস্থা না করেই দেদার পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলেছে। এতে ব্যাপক ভিত্তিতে বৈদেশেক মুদ্রার দায় সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) আমদানির প্রবৃদ্ধি হয় ২৫ দশমিক ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ ১০ মাসে ৪ হাজার ৯০১ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় হয়। বিপরীতে গত অর্থবছরে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয় ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ, অর্থাৎ রফতানির মাধ্যমে আয় হয় ৩ হাজার ৩৭৩ কোটি ডলার এবং রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি হয় ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ রেমিট্যান্স আসে ১ হাজার ৪৯৮ কোটি মার্কিন ডলার। এতে দেখা যায় রফতানি ও রেমিট্যান্স মিলে যে অর্থ দেশে আসে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ব্যয় হয় আমদানিতে, তাও আবার ১০ মাসে। বৈদেশিক মুদ্রার এ চাহিদা ও যোগানের মধ্যে যে বিরাট ফারাক সৃষ্টি হয় এটা পূরণ করা হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে।