৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং | ১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১১:৩৫

বাসশূন্য ঢাকার রাজপথ 

নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাসের চাপায় বিমানবন্দর সড়কে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চলমান আন্দোলনের জের ধরে আজ বুধবার ঢাকার রাজপথে বাসের দেখা মিলছে না। বাসশূন্য রাজপথ অনেকটাই খা খা করছে। ব্যক্তিগত যানবাহনের পাশাপাশি সামান্য কিছু রিকশা, অটোরিকশা দেখা যাচ্ছে। অফিসযাত্রীদের বেশির ভাগকেই হেঁটে যেতে দেখা যাচ্ছে।

ছাত্রদের ৯ দফা দাবিতে উত্তাল রাজধানী। রমিজ উদ্দিন কলেজ ক্যাম্পাস থেকে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো শহরে। যেখানেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখানেই শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছেন। তারা রাস্তা অবরোধ করেছেন, যানবাহন ভাঙচুর করেছেন, গাড়িতে আগুন দিয়েছেন। কোনো কোনো এলাকায় শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করেছে পুলিশ। সব মিলিয়ে গতকাল বেলা ১১টার পর থেকে রাজধানী ছিল অচল। রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে থাকতে হয় যাত্রীদের। গাজীপুর, টঙ্গী ও উত্তরার সাথে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল রাজধানী।

গাড়িচাপায় শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনা নিয়ে ছাত্র আন্দোলনের মুখে গতকাল মঙ্গলবার পুরো রাজধানীই অচল হয়ে পড়ে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছেন। সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলন ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। তা উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা সকাল ১০টার পর থেকে বিভিন্ন স্থানে জড়ো হতে থাকেন।

সকাল ১০টায় ফার্মগেট সংলগ্ন সড়ক অবরোধ করেন বিজ্ঞান কলেজ ও তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সময় পুরো এলাকা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে পুলিশের সাথে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, এ হত্যায় জড়িতদের ফাঁসি দিতে হবে। বেলা সাড়ে ১১টায় মিরপুর-১ নম্বর সড়কে অবস্থান নেন ঢাকা কমার্স কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা দু’টি বাসে ইটপাটকেল ছুড়ে ভাঙচুর চালান। এ ছাড়াও মিরপুর-১০ নম্বর চত্বরে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। রাজধানীর বাড্ডায় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা হাতিরঝিল সংলগ্ন সড়ক অবরোধ করেন, যা পুরো রামপুরা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এ এলাকায় ১০-১৫ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। সেখানে একপর্যায়ে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হয় শিক্ষার্থীদের। পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

এ দিকে তেজগাঁওয়ে নাবিস্কোর সামনে নিরাপদ সড়ক ও শিক্ষার্থীদের সড়কে গাড়িচাপা দিয়ে হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেন সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। এসময় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তারা। কাফরুল এলাকায় শহীদ স্মৃতি পুলিশ কলেজের শিক্ষার্থীরা দুপুরে রাস্তা অবরোধ করতে চাইলে তাদের সাথে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। এখানে পুলিশের লাঠিচার্জে এক ছাত্র আহত হন। পুলিশের লাঠিপেটায় ওই শিক্ষার্থীর মাথা ফেটে যায়। ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা বেলা দেড়টায় মিরপুর রোডে মানববন্ধন করেন। সড়ক অবরোধ করে তারা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে স্লোগান দেন। তারা কলেজের সামনে হিমাচল পরিবহনের একটি গাড়িতে আগুন দেন। এক পর্যায়ে সেখানে পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সেখানে আরো কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় অবস্থান করেন। উত্তরা হাউজ বিল্ডিংয়ের সামনে বিজিএমইএ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুপুরে রাস্তা অবরোধ করেন। সেখানে শিক্ষার্থীরা পাঁচটি বাস ও একটি পিকআপ ভাঙচুর করেন। পুলিশের সাথে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সেখানে বুশরা পরিবহনের একটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। প্রায় দুই ঘণ্টা উত্তরার পুরো এলাকায় যান চলাচল বন্ধ ছিল। এতে বিমানবন্দর সড়কটি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। বেলা ২টা ১৫ মিনেটে মিরপুর রোডের আগারগাঁও এলাকায় শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করেন। সেখানে পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। দুপুরে নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা মতিঝিল শাপলা চত্বরে অবস্থান নেন। তারা শাপলা চত্বর থেকে চার দিকের যানবাহন বন্ধ করে দেন। প্রায় দুই ঘণ্টা তারা রাস্তায় অবস্থান করে বিক্ষোভ করেন। এ সময় স্থবির হয়ে পড়ে পুরো ব্যাংকপাড়া।

গত ২৯ জুলাই দুপুরে ছুটির পরে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র আবদুল করিম সজীব ও একই কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী দিয়া খানম মিম নিহত হন। তারা রাস্তার পাশের ফুটপাথে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস তাদের চাপা দিয়ে মেরে ফেলে। এ ছাড়া বেশ কয়েক শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। পথচারীরা সাথে সাথে আহতদের নিকটস্থ কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে গুরুতর আহত কয়েকজনকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়।

ঘটনার পর থেকেই উত্তাল হয়ে ওঠে রাজধানী। ঘটনাস্থলে জাবালে নূর পরিবহনের বাসটিতে আগুন দেয়া হয়। সেখানে ভাঙচুর করা হয় আরো শতাধিক বাস। পরদিন ফের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামেন। তারা হোটেল রেডিসনের সামনে সড়ক অবরোধ করে এ হত্যার বিচার চান। সেখানে পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার একপর্যায়ে বিকেল ৪টার পরে ছাত্ররা রাস্তা ছেড়ে দেন। গতকাল ওই স্থানে ছাত্রদের দাঁড়াতে না দিলেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে গোটা রাজধানীতে। ছাত্ররা ৯ দফা দাবি তুলেছেন। দাবিগুলো হলো দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় দায়ী বেপরোয়া চালককে ফাঁসি দিতে হবে, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহাজাহান খানকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে, শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্পিড ব্রেকার দিতে হবে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের দায়ভর সরকারকে নিতে হবে, শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে থামিয়ে তাদের নিতে হবে, শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে, ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকেরা গাড়ি চালাতে পারবেন না এবং বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া যাবে না।

প্রকাশ :আগস্ট ১, ২০১৮ ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ