ক্রীড়া ডেস্ক:
আগের তথা স্বর্ণ সময়ের কথা বাদ। এখন ভাবা হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ এখন টেস্টের চেয়ে একদিনের সীমিত ওভারের ফরম্যাটেই বেশি শক্তিশালী। আসলেই কি তাই? ক্যারিবীয়রা কি সত্যি সত্যিই এখন টেস্টের চেয়ে ওয়ানডেতে সমৃদ্ধ আর শক্তিশালী দল ?
এমন প্রশ্ন শুনে নিশ্চয়ই অনেকে ভ্রু কুচকে উঠবেন। কেউ কেউ বাঁকা চোখে তাকাবেন বা ভ্রুকুটি করবেন। বলবেন, যে দলে গেইলের মতো বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান আছেন, নিজের দিনে যে কোনো বোলিংকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়ার পর্যাপ্ত ক্ষমতা আছে যার। সাথে এভিন লুইস, এই ক্যারিবীয় যুবকও কম যান না। সময়ের অন্যতম সেরা ক্লিন হার্ড হিটার। এবং আন্দ্রে রাসেলের মতো সীমিত ওভারের অতি কার্যকর অলরাউন্ডার; যার ব্যাট ও বল দুই-ই সমান। সেই দল কি করে টেস্টের চেয়ে ওয়ানডেতে দুর্বল হয়? তাদের জন্য ব্যাখ্যা-বেশি না, গত চার বছরের ইতিহাস পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখুন। দেখবেন, ক্যারিবীয়রা এ সময়ে ওয়ানডের চেয়ে টেস্টেই তুলনামূলক সফল।
ইতিহাস ও পরিসংখ্যান পরিষ্কার বলে দিচ্ছে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ অন্তত গত চার বছরে ওয়ানডের চেয়ে বরং টেস্টই ভালো খেলেছে। ক্যারিবীয়দের এ সময়ের টেস্ট রেকর্ডই তুলনামূলক বেটার। আসুন দেখে নেই।
টেস্টে তাও গত চার বছরে দুটি সিরিজ বিজয়ের কৃতিত্ব আছে ক্যারিবীয়দের। কিন্তু ওয়ানডেতে তাও নেই। সেই ২০১৪ সালে দেশের মাটিতে বাংলাদেশকে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ হারানোই শেষ। তারপরও দেশে ও বিদেশে ১০ ওয়ানডে সিরিজের একটিতেও জয়ের দেখা পায়নি ক্যারিবীয়রা।
শুধু ২০১৭ সালের জুনে দেশের মাটিতে অাফগানিস্তানের সাথে তিন ম্যাচের একদিনের সিরিজ ১-১ ‘এ অমীমাংসিত থেকে গেছে। একটি ম্যাচ বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হয়েছে ।
অন্যদিকে, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঘরের মাঠে বাংলাদেশের বিপক্ষে দুই ম্যাচের সিরিজ ২-০ তে জেতার পর গত চার বছরে ১৩ টেস্ট সিরিজে ক্যারিবীয়রা মাত্র একবার সিরিজ জিতেছে। তাও সেটা সবার নিচে থাকা দুর্বল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। সেটাও খুব অনায়াসে নয়। ১-০ ‘তে। অন্য ম্যাচটি ড্র থেকে গেছে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে জিম্বাবুয়ের মাটিতে দুই ম্যাচের সিরিজটি ১-০ ‘তে জেতার পর আর একটি মাত্র সিরিজ ড্র করেছে ক্যারিবীয়রা। সেটা এই গেল মাসে ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। প্রথম টেস্ট ২৩৮ রানে জিতে, শেষ ম্যাচ উল্টো ৪ উইকেটে হারে ক্যারিবীয়রা। দ্বিতীয় ম্যাচটি ড্র থেকে যায়।
তার মানে কি দাঁড়ালো? ওয়েস্ট ইন্ডিজকে যত ভয়ঙ্কর আর বিপজ্জনক দল ভাবা হচ্ছে বাস্তবে ততটা নয়। বরং বাংলাদেশ টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টির চেয়ে ৫০ ওভারের ফরম্যাটে ভালো দল।
তাহলে ওয়ানডে সিরিজটি কেমন হবে? সেয়ানে সেয়ানে লড়াই? নাকি ঘরের মাঠে ক্যারিবীয়দের শৌর্য্য-বীর্য্যর সাথে শেষ পর্যন্ত কুলিয়ে উঠতে পারবে না মাশরাফির দল? ফুটবল বিশ্বকাপ শেষ হতেই শুরু হয়ে গেছে হিসেব-নিকেশ। জল্পনা-কল্পনা আর গুঞ্জন, ফিসফাস। পক্ষ-বিপক্ষ দুদিকেই যুক্তি আছে।
কেউ কেউ হয়তো বলে উঠবেন- আরে, ওয়ানডেতে ক্রিস গেইল, এভিন লুইস, আন্দ্রে রাসেলের মত তিন তিনজন স্পেশালিস্ট পারফরমার থাকবেন, তাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের পাল্লা ভারি। একদিনের সিরিজেও তাই ক্যারিবীয়রা ফেবারিট। ইতিহাস কিন্তু একটা অন্যরকম তথ্য দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ফেবারিটের তকমা গায়ে এঁটে ভালোর চেয়ে খারাপ খেলে বেশি। বেশি দূর যেতে হবে না, এ বছর ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার সাথে ফেবারিট লেভেল গায়ে এঁটে সব ফরম্যাটেই ব্যর্থ হয়েছে টাইগাররা।
এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে টেস্টেও কিন্তু র্যাঙ্কিংয়ে ওপরে ছিল বাংলাদেশ। শুধু তাই নয় , কাগজে কলমেও সাকিবের দলই ছিল এগিয়ে। নাম-ডাক , তারকাখ্যাতি, ব্যক্তিগত অর্জন, সাফল্য আর অভিজ্ঞতাকে মানদন্ড ধরলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট দলটি কিন্তু আহামরি কিছু ছিল না। অতীতে এর চেয়ে অনেক পরিণত, অভিজ্ঞ, সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হয়েছে টাইগাররা। বরং ব্যাটিং ডিপার্টমেন্টে বাংলাদেশের তামিম, মুমিনুল, মুশফিক, সাকিব ও মাহমুদউল্লাহরাই ছিলেন এগিয়ে।
কিন্তু মাঠে বাংলাদেশ কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়ে তুলতে পারেনি। অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে। আসুন দেখে নেই, এন্টিগা ও জ্যামাইকা টেস্টে কেমন দল ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ? যিনি ছিলেন মূল ব্যাটসম্যান, তথা এক নম্বর ওপেনার, সেই ২৫ বছর বয়সী ক্রেইগ ব্রেথওয়েটের (৪৯ টেস্টে আট সেঞ্চুরি আর ১৭ হাফ সেঞ্চুরিতে ৩৭.৯৪ গড়ে ৩২৬৩ রান) ট্র্যাক রেকর্ড একদম বাংলাদেশের এক নম্বর ওপেনার তামিম ইকবালের (৫৬ টেস্টে আট শতক ও ২৫ অর্ধশতক ৩৭.৮৪ গড়ে ৪০৪৯ রান) মত।
এছাড়া স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানের তকমা নিয়ে নিয়ে যারা খেলেছেন, সেই ডেভন স্মিথ (৪৩ টেস্টে এক সেঞ্চুরি ও আট হাফসেঞ্চুরিতে ১৭৬০ রান), কাইরন পোলার্ড (৩৬ টেস্টে তিন শতক ও পাঁচ অধর্শতকসহ ১৮৮১), শাই হোপ (২২ টেস্টে ১২১০) ও রস্টন চেইজ (২২ টেস্টে তিন সেঞ্চুরিসহ ১২৪২)- কারোর পরিসংখ্যান মুমিনুল হক (২৯ টেস্টে ছয় সেঞ্চুরি ১২ হাফসেঞ্চুরিতে ২১৭০ রান), মুশফিকুর রহিম (৬২ টেস্টে পাঁচ শতক ও ১৯ সেঞ্চুরিতে ৩৬৯৯ রান), সাকিব আল হাসান (৫৩ টেস্টে পাঁচ সেঞ্চুরি, ২৩ হাফসেঞ্চুরিতে ৩৬৯২ রান) ও মাহমুদউল্লাহর (৩৯ টেস্টে এক শতক ও ১৫ অর্ধশতকে ২০৮৪) চেয়ে উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ নয়।
তারপরও বাংলাদেশ চরমভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে। প্রথম টেস্টে ইনিংস ও ২১৯ রানে আর শেষ ম্যাচে ১৬৮ রানের বড় জয়ে মাঠ ছেড়েছে ক্যারিবীয়রা।
টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের সবচেয়ে কম, ৪৩ রানে অলআউট হবার লজ্জায় ডোবার সাথে দুই টেস্টে বাকি তিন ইনিংসে (১৪৪, ১৪৯ ও ১৬৮) একবারও ২০০ রান করা সম্ভব হয়নি।
আসলে বাংলাদেশ পর্যুদস্ত হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাস্টবোলারদের দুর্দান্ত গতি, বাড়তি বাউন্স ও বিষাক্ত সুইংয়ের কাছে। আর তাই তো দুই টেস্টের তিন ইনিংসে (৪০৬, ৩৫৪ ও ১২৯) স্বাগতিকদের অলআউট করার পরও এতটুকু প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারেনি। একপেশে ফল হয়েছে।
তিন ক্যারিবীয় ফাস্টবোলার কেমার রোচ, জেসন হোল্ডার আর শ্যানন গ্যাব্রিয়েলই পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন। ওয়ানডেতে এই তিন ভয়ঙ্কর পেসারের মধ্যে কেবলমাত্র হোল্ডারই থাকবেন ওয়ানডে সিরিজে। এটা একটি স্বস্তির কারণ। আবার চিন্তার খোরাকও আছে।
যার নাম শুনলেই অনেক বাঘা বাঘা বোলারের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে; সেই ভয়ঙ্কর, বিধ্বংসী উইলোবাজ ক্রিস গেইল, সময়ের অন্যতম ক্লিন পিঞ্চ হিটার এভিন লুইস আর যে কোনো বোলিং শক্তিকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়ার পর্যাপ্ত ক্ষমতার অধিকারী আন্দ্রে রাসেল থাকবেন ওয়ানডে সিরিজে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের আরেকটি অ্যাডভান্টেজ, এই তিনজনই বিপিএলে খেলেন নিয়মিত। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সম্পর্কে স্বভাবতই ভালো ধারণা আছে তাদের। এরই মধ্যে জানা হয়ে গেছে, সীমিত ওভারের ফরমেটে আন্দ্রে রাসেল এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা, সফল ও কার্যকর অলরাউন্ডার। কিন্তু গত তিন বছর দলের বাইরে ছিলেন এমন ‘ইউটিলিটি’ ক্রিকেটার। এবার তার অন্তর্ভূক্তিতে কাগজে কলমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিকট অতীতের তুলনায় কিছুটা হলেও বেটার সাইড।
দেখা যাক, ক্যারিবীয়দের মাঠে হোল্ডার-বাহিনীকে কিভাবে মোকাবিলা করে মাশরাফির দল?