অর্থনীতি ডেস্ক:
‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক সাফল্য অব্যাহত রাখতে হলে অবশ্যই আর্থিক খাতে বহু কষ্টের পর যে স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব হয়েছে তা ধরে রাখতে হবে’ বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। আজ ঢাকার আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ গভর্নেন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের উদ্যোগে আয়োজিত এক বিশেষ অধিবেশনে তিনি এ কথা বলেন।
অধিবেশনটির উদ্দেশ্য ছিলো সরকারি ও অন্যান্য কমকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক রূপান্তরের গল্পটি কেবল উন্মোচিত হতে শুরু হয়েছে, সামনে আরও অনেক ইতিবাচক রূপান্তর হবে। তাঁর মতে ১৯৭২ সালে মাত্র ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতি থেকে খুব অল্প সময়েই বাংলাদেশের ৪৩-তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে (যার আকার প্রায় ২৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াটি প্রকৃত অর্থেই প্রেরণাদায়ক। তার চেয়েও অবাক করা বিষয় হলো, অর্থনীতির তিনটি খাতেই, অর্থাৎ শিল্প, সেবা ও কৃষিতে- ধারাবাহিকভাবে উন্নয়ন ঘটতে দেখা গেছে। ফলে গত এক দশকে মাথাপিছু আয় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনার পাশপাশি স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং পুষ্টি খাতসহ সকল ক্ষেত্রেই সামাজিক উন্নয়নের সূচকগুলোতে অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে। আর তাই আমাদের প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ বছরে। এই অংক দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
এই অভাবনীয় ইতিবাচক পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে সরকারের সুচিন্তিত উন্নয়ন নীতির কারণে।
পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক অন্তর্ভূক্তির কৌশলও এখানে সহায়ক হয়েছে। এই নীতি-কৌশলের মূল জোর ছিলো- ১) উচ্চ প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি সকল নাগরিকের অন্তর্ভূক্তি নিশ্চিত করা, ২) সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির কার্যকর প্রয়োগ, এবং ৩) আত্মনির্ভরশীলতার পাশাপাশি বেসরকারি অংশীজনের সাথে যুগপৎ কাজ করার প্রত্যয়ে। একই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রতি বছর ২০ লক্ষ মধ্যম বা উচ্চ আয়ের মানুষ যুক্ত হচ্ছেন। এদের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ৫,০০০ মার্কিন ডলারের বেশি। এসব মানুষ ভোক্তা হিসেবে ব্র্যান্ডের পণ্যের উপর আস্থাশীল এবং আধুনিক প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। তাই তারা বাজারে উচ্চ মানসম্পন্ন পণ্য ও সেবা প্রত্যাশা করেন। ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৩৩টি নগর এলাকা থাকবে যেগুলোর প্রতিটিতে এমন মধ্যম বা উচ্চ আয়ের মানুষের সংখ্যা হবে অন্তত তিন লক্ষ। বর্তমানে এমন শহরের সংখ্যা দশটি। কাজেই বাংলাদেশের বিনিয়োগকারিদের এই নতুন বাজারের কথা মাথায় রেখে নিজেদের ব্যবসার কৌশল ঠিক করতে হবে।
ড. আতিউর বলেন, বাংলাদেশের প্রত্যাশিত সামষ্টিক অর্থনৈতিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন: প্রতি বছর ১৬ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, কয়লা ও গ্যাসের মতো প্রাকৃতিক সম্পদের মজুদ শেষ হয়ে আসা, রপ্তানি আয়ের জন্য গার্মেন্ট খাতের ওপর একক নির্ভরশীলতা, দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে অবকাঠামোর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি ও নগরাঞ্চলে সুশাসন কঠিন হয়ে ওঠা। আর্থিক খাতের অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি এসব চ্যালেজ্ঞগুলোকে আরও কঠিন করে তুলছে। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের অবশ্যই কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিশেষ করে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশ, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহায়তা জোরদার করা, উৎপাদনশীল এবং টেকসই কৃষি, গার্মেন্ট শিল্পের পাশাপাশি অন্যান্য রপ্তানিমুখী শিল্পের বিকাশ, নিজস্ব বাজারের উপযোগী পণ্য উৎপাদন এবং যে কোন মূল্যে আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ধরে রাখায় মনোনিবেশ করতে হবে বলে অভিমত দেন ড. আতিউর।
পাশাপাশি আমাদের এমন অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করতে হবে যা হবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি সংবেদনশীল, যেখানে মূখ্য ভ‚মিকায় থাকবে বেসরকারি খাত, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের ওপর থাকবে বিশেষ মনযোগ, এবং সর্বস্তরে থাকবে ডিজিটাল প্রযুক্তি ও ই-কমার্সের ব্যাপক ব্যবহার। সর্বোপরি সরকারের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা থাকবে যেন দক্ষতা বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়, যাতে করে সবাই শেখার সুযোগ পায় আর উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় অংশ গ্রহণ করতে পারে।