ক্রীড়া ডেস্ক:
মস্কো শহর ভেদ করে বয়ে চলা মস্কোভা নদীর স্রোত বয়ে চলবে আগের মতই। বিমানবন্দরগুলোর বিমান আকাশে ওড়ার সূচিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। আগের মতই বিমানগুলো আকাশে উড়বে। মস্কো থেকে রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলোর সূচিতেও কোনো পরিবর্তন আসবে না। কিংবা সকাল ৯টায় যিনি অফিসে যাওয়ার জন্য গাড়ী বের করে আনতেন রাস্তায়, তারও কোনো নিয়মের ব্যাত্যয় ঘটবে না।
সবই চলবে আগের নিয়মে, আগের গতিতে। শুধুমাত্র স্তব্ধ হয়ে যাবে বিশ্বকাপের জন্য সাজানো ১১ শহরের ১২টি স্টেডিয়াম। ২০১০ সালের ২ ডিসেম্বর জুরিখে ফিফার কংগ্রেসে ভোটাভুটিতে ইংল্যান্ড, স্পেন-পর্তুগাল এবং নেদারল্যান্ডস-বেলজিয়ামের যৌথ প্রতিদ্বন্দ্বীতাকে পেছনে ফেলে ২০১৮ বিশ্বকাপ আয়োজকের স্বত্ত্ব জিতে নেয় রাশিয়া।
সেই থেকে প্রস্তুতি শুরু। আট বছরের বিশাল কর্মযজ্ঞ। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের পর থেকে পুরোপুরি প্রস্তুতি শুরু বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশটির। সব প্রস্তুতি, আয়োজন, জ্বল্পনা-কল্পনা শেষ করে অবশেষে ১৪ জুন শুরু হয়েছিল দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ, ২১তম বিশ্বকাপ ফুটবলের জমজমাট আসরের। বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পর্দা উঠেছিল এবারের আসরের।
৩২টি দল, ৬৪টি ম্যাচ আর ১১ শহরের ১২টি সুসজ্জিত ভেন্যু- নানা চমকের বিশ্বকাপ অবশেষে শেষ হতে চললো। ৩২ দল থেকে বিদায় নিতে নিতে বাকি রয়েছে আর মাত্র দুটি। ফ্রান্স এবং ক্রোয়েশিয়া। এরই মধ্যে ২বার বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলে ফেলেছে ফ্রান্স। আর এই প্রথম বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠলো ক্রোয়াটরা। লেভ ইয়াসিনের দেশ থেকে কে তুলে ধরবে বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফিটা? হুগো লরিস নাকি লুকা মদ্রিচ? জানা যাবে, রোববার রাত ১১টা কিংবা তার কিছু পর।
রাশিয়ার রাজধানী মস্কো এখন পুরোপুরি ফ্রান্স আর ক্রোয়েশিয়ার দখলে। দুই ইউরোপিয়ান দেশের লড়াই। একমাসের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতা শেষে ট্রফি জয়ের শেষ নিশানায় এসে উপস্থিত ফ্রান্স এবং ক্রোয়েশিয়া। এই দুই দেশের সমর্থকদেরই তো মস্কোয় গিজ গিজ করার কথা। ক্রোয়েশিয়া তো ঘোষণা দিয়েছে, তাদের দেশের ৪৫ লাখ জনসংখ্যার শতভাগই বিশ্বকাপের দর্শক। পারলে তারা সবাই যেন মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে উপস্থিত থাকে!
মস্কোর চিত্রটা এখন এমন- হঠাৎই সেখানে ‘ওলে ওলে’ বলে নাচতে শুরু করে দিচ্ছে এক দল বিদেশি। ক্রোয়েশিয়ার তরুণকে দেখে সেলফি তুলতে হাজির হয়ে যাচ্ছে শান্ত রাশিয়ান সুন্দরী। সেন্ট বাসিলে গির্জা এবং সোয়ানস্কি টাওয়ার- মস্কোর দুই সবচেয়ে পরিচিত প্রতীকের মাঝখানে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলছেন অজস্র ফরাসি এবং ক্রোয়াট। আছে পৃথিবীর নানান দেশের ফুটবলপ্রেমীরাও। বিশ্বকাপের বিদায় রাগিনীর সূরে মেতে উঠতে যেন তারও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ফ্রান্স-ক্রোয়েশিয়া ফাইনাল হওয়ায় হয়তো ভিনদেশিরা হতাশ! তবে গ্রিজম্যান-এমবাপে-পগবা এবং মদ্রিচ-রাকিটিচ-মানজুকিচের ফুটবল সৌন্দর্যে অনেক আড়ালে চলে গেছে আরও অনেক আলোকিত মুখ। রোনালদো-মেসি-নেইমার-ক্রুস-ইনিয়েস্তা। বিশ্বসেরার মঞ্চে এসে এরা সবাই ব্যর্থ। কে সেরা তাহলে? নিশ্চিত অর্থেই এবারের বিশ্বকাপের আগেই আবিস্কার হওয়া কাইলিয়ান এমবাপে, আন্তোনিও গ্রিজম্যান, ক্রোয়েশিয়ার মদ্রিচ, রাকিতিচ কিংবা মানজুকিচরা। বিশ্বকাপের সোনার বল, ফিফার ‘দ্য বেস্ট’, ফরাসি ব্যালন ডি’অরের জন্য এবার ভিন্ন দাবিদার মঞ্চে উপস্থিত। লুকা মদ্রিচ কিংবা আন্তোনিও গ্রিজম্যান। পেরিসিচ কিংবা এমবাপে।
স্বেচ্ছাসেবকদের লাল পোশাক পরে লুঝনিকি স্টেডিয়ামে শুক্রবার সংবাদমাধ্যমের সামনে এসে ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফ্যান্তিনো বললেন, ‘রাশিয়া বিশ্বকাপই সর্বকালের সেরা।’ ইনফ্যান্তিনোর দাবির স্বপক্ষে জোরালো যুক্তি আছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রাশিয়া বিশ্বকাপ যে নাটকীয়তা উপহার দিল, তাতে এই বিশ্বকাপকে সেরা না বলে উপায় নেই।
রাশিয়ান উপপ্রধানমন্ত্রী ওলগা গোলোদেতেসের হিসাবটা একটু ভিন্ন। তার মতে, বিশ্বকাপের প্রেক্ষাপটে আগামী বছর বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে ১৫ শতাংশ। বিশ্বকাপের জন্য ৭ লক্ষ বিদেশি এসেছেন এই দেশটিতে। তারা যে অভিজ্ঞতা নিয়ে যাচ্ছে, আগামীতে রাশিয়ায় পর্যটক না বাড়ার কোনো কারণই নেই।
বিশ্বকাপ ফাইনালিস্ট দুটো দলে উদ্বাস্তু, শরণার্থী, রাজনৈতিক আশ্রয়ের এত অঙ্ক লেগে রয়েছে যে, রাশিয়াকেই যেন তা মানায়। প্রথম থেকে যে বিস্ময়ের সন্ধানে রাশিয়া ছুটেছে, তারই ফুল ফুটেছে ফাইনালের দুটো দলে। ফুটবলের হিসেব বলছে, এখানে সেরা আক্রমণাত্মক ও ধ্বংসাত্মক পাসার দুটোই ফ্রান্সের। পল পগবা এবং এনগোলো কান্তে।
পগবার ইতিহাস সবাই জানে। কান্তে এক বিস্ময়। এখন তিনি বার্সেলোনার এক নম্বর টার্গেট। ২০ বছর আগের এক জুলাইয়ে যেদিন দেশম-জিদানরা বিশ্বকাপ জিতছেন, সেদিন বাবা-মায়ের সঙ্গে প্যারিসের শহরতলির রাস্তায় ডাস্টবিন পরিষ্কার করছেন কান্তে। সব নোংরা জোগাড় করে রিসাইকেল প্ল্যান্টে পাঠাবেন বলে।
বাবার মৃত্যুর পর ফুটবল ছেড়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন কান্তে। ভেবেছিলেন, ১.৬৮ মিটার লম্বা হয়ে ফুটবল খেলা যাবে না। সতীর্থদের সবার গাড়ি থাকত প্র্যাক্টিসে যাওয়ার। কান্তেকে সবাই লিফট দিতে চাইতেন। কান্তে যেতেন স্কুটারে।
সেই তিনিই, দরিদ্র কাগজকুড়ানো বিশ্বকাপ ফাইনালের আকর্ষণের কেন্দ্রে। অনেকে বলছেন, তিনিই বিশ্বকাপে ফ্রান্সের সেরা ফুটবলার। আড়ালে কাজ করেছেন অনর্গল। দ্বিতীয় ক্লদিও ম্যাকেলেলে যেন। কী আকাশছোঁয়া উত্তরণ! মালির কান্তেও ক্যামেরুনের এমবাপের মতো ফ্রান্স ছাড়ার প্রস্তাব পেয়েও যাননি। কী ভাগ্য!
রাশিয়া যে ফাইনালের পাশে আরও বিস্ময়ের জন্ম দেবে, তা স্পষ্ট হয়ে গেল শুক্রবার লুঝনিকিতে হলিউড সুপারস্টার উইল স্মিথের উপস্থিতিতে। রাশিয়ান বিশ্বকাপের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে সেরা মুখ আমেরিকান অভিনেতা- আর কী বিস্ময় থাকতে পারে? উইল স্মিথের পাশে কসোভার গায়িকা ইরা ইস্ত্রেফি। রাশিয়ান মঞ্চে কসোভান গায়িকা। এখন যাকে রিহানার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। প্রেস মিটে এসে নানা রকম অদ্ভুত অদ্ভুত চিৎকার শুরু করে দিলেন স্মিথ। একবার চলে যাওয়ার ভঙ্গি করে উঠে পড়লেন। তারপর ফিরে এলেন হলিউডের ‘সবচেয়ে শক্তিশালী অভিনেতা’ উইল স্মিথের অভিব্যক্তিতে।
সব মিলিয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনাল অপেক্ষা করছে ভিন্ন এক অনুভূতি আর বর্ণময় এক অভিজ্ঞতা নিয়ে। ৯০ মিনিট কিংবা ১২০ মিনিট, বড় জোর এরপর টাইব্রেকার। তারপরই তো নির্ধারণ হয়ে যাবে কে বিশ্বসেরা। ফ্রান্স না ক্রোয়েশিয়া? বিশ্বকাপ আসলেই তুমি কার?