শিল্প ও সাহিত্য ডেস্ক:
বাংলা ভাষায় বিশেষ্যে সরল অর্থ শালগাছ বা দেবদারু জাতীয় সরল গাছ। ঋজু (সরলরেখা) অর্থেও শব্দটি বিশেষ্য। আবার বিশেষণেও ঋজু, অবক্র বা সোজা অর্থে শব্দটি চালু রয়েছে (যেমন সরল অঙ্ক)।
এছাড়া কুটিলতাশূন্য বা অকপট (এখানকার মানুষগুলি এমনি অনুরক্ত ভক্তস্বভাব, এমনি সরল বিশ্বাসপরায়ণ যে, মনে হয় আডাম ও ইভ জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাইবার পূর্বেই ইহাদের বংশের আদিপুরুষকে জন্মদান করিয়াছিলেন- পল্লীগ্রাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর), শান্তশিষ্ট (তখনো সরল সুখী আমি ফোটেনি যৌবন মম, উন্মুখ বেদনামুখী আসি আমি ঊষাসম, আধ-ঘুমে আধ-জেগে তখনো কৈশোর, জীবনের ফোটো-ফোটো রাঙা নিশিভোর- পূজারিণী, কাজী নজরুল ইসলাম), সাধু প্রকৃতির বা উদার (প্রকৃতির একান্ত সারল্য এবং ভাবের একাগ্র বেগ না থাকিলে এমন অসঙ্কোচ বাক্য কাহারো মুখ দিয়া বাহির হয় না- ব্রহ্মমন্ত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; তাহা চিত্তের ঔদার্য অথবা সারল্যের প্রাচুর্য, এ ভ্রম যেন কেহ না করেন- শ্রীকান্ত, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়), সাধাসিধা (তাহার পিতাকে লোকে বিত্তশালী ব্যক্তি বলিয়াই জানিত, অথচ পল্লীগ্রামের সরল জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতেন- দত্তা, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) অর্থেও শব্দটি চালু।
বাংলায় আমরা ‘সরপুঁটি’ বলতে বড় আকারের পুঁটি মাছকে বুঝি। এটার অন্য নাম হচ্ছে ‘সরল পুঁটি’।
সরল শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ সরলা (কিন্তু কুন্দ অসমান্যা সরলা এবং আশুসন্তুষ্টা- সুতরাং হীরার এই নূতন প্রিয়কারিতায় প্রীতা ব্যতীত সন্দেহবিশিষ্টা হয় নাই- বিষবৃক্ষ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)।
সরলতা বিশেষ্য। এটার অর্থ সারল্য, অকপটতা, সরলভাব (যেমন তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য, তেমনি ছেলেমানুষের মতো তাঁর সরলতা- তিনসঙ্গী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; প্রথম যৌবনসঞ্চারের অব্যবহিত পূর্বেই যেরূপ মাধুর্য এবং সরলতা থাকে, পরে তত থাকে না- বিষবৃক্ষ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; অথচ সে হাসিতে সরলতা ও বালিকাভাব ব্যতীত আর কিছুই ছিল না- দুর্গেশনন্দিনী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)।
সরল শব্দটির গঠন হচ্ছে সংস্কৃত (সৃ + অল (কল্)।
এটা ঠিক, সরস সংস্কৃত শব্দ। মূলানুগ অর্থে সরস মানে রসযুক্ত বা রসালো (তীক্ষ্ম শর সরস শরীরে- মাইকেল মধুসূদন দত্ত; করিয়াছ পান চুম্বন ভরা সরস বিম্বাধরে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
কিন্তু শব্দটি বেশ গতিশীল। তাই শব্দটির রয়েছে নানা ব্যঞ্জনা। বিশেষণে সরস মানে রসিকতায় পরিপূর্ণ, রসিক, সহৃদয় (ভারত সরস ভাষে- ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর), সৌন্দর্যপূর্ণ, প্রীতিদায়ক (সরস বসন্তকালে সারী শুক যথা- মধুসূদন দত্ত; আমাদেরও দেশ আছে। আহা কি সরস মাটি- স্বদেশী কোরাস, আবুল হোসেন)।
কিন্তু বিশেষ্যে সরস মানে সরোবর বা হ্রদ। সরসতা শব্দটিও বিশেষ্য। এটার অর্থ মাধুর্য, রসযুক্ততা, রসপূর্ণতা (যে কোনো প্রসঙ্গ নিয়ে চলতো কথা, সরসতার অভাব হতো না- বুদ্ধদেব বসু)।
সরস শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ সরসা। এটার অর্থ রসযুক্তা বা রসালো (ধূসর নীরস ধরা হল সরসা- কাজী নজরুল ইসলাম)।
সরস শব্দের গঠন হচ্ছে সংস্কৃত স (সহ) + রস। আর এ সরস শব্দ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে আরেক সংস্কৃত শব্দ সরেস। শব্দটি শুধু বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বিশেষণে সরেস মানে প্রকৃষ্ট, শ্রেষ্ঠ, উত্তম, উৎকৃষ্ট (সরেস নিরেশ মালের বাছবিচার হয়- সৈয়দ মুজতবা আলী; শহরের বড় মানুষদের মধ্যে অনেকেই পদ্মলোচনের জুড়িদার কেউ কেউ দাদা হতেও সরেস- হুতোম প্যাঁচার নকশা, কালীপ্রসন্ন সিংহ); রসপূর্ণ, রসাত্মক (ম্যাটসিনি নীলা এমন সরেস- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর); প্রসাদগুণসম্পন্ন বা রসালো (লেখাটা বড় সরেস হয়েছে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; কালী আবার এর চেয়ে এককাটি সরেস- একেই কী বলে সভ্যতা, মাইকেল মধুসূদন দত্ত; আমাদের জ্ঞাতিরা দুর্যোধনের বাবা, তাদের মেয়েরা কৈকয়ী ও সূর্পনখা হতেও সরেস!- হুতোম প্যাঁচার নকশা, কালীপ্রসন্ন সিংহ)।
তবে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি ‘সরেস’ শব্দটিকে গ্রামীণ প্রয়োগ বলেছেন। তার মতে, সরেসের সমতুল শব্দ ওড়িয়াতে সরসা, হিন্দিতে সরস, মরাঠিতে সরসা।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ