২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৩:৪৪

ঢাকায় গ্যাস সংকট: বিপর্যস্ত নগরজীবন

নিজস্ব প্রতিবেদক:

সারাদেশে চলছে গ্যাস সংকট। রমজানে এ চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে তফাত আরো বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীতে সমস্যাও প্রকট। গ্যাস না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন সবশ্রেণির মানুষ। বিকল্প সুযোগ থাকা গ্রাহকরা বেশি টাকা খরচ করে এলপিজি বা কেরোসিন তেলের চুলা ব্যবহার করলেও স্বল্প আয়ের মানুষ পড়েছেন সবচেয়ে বেশি বিপদে। ২৪ ঘন্টার যেকোনো সময় দুই-এক ঘন্টার গ্যাসের জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করছেন তারা। আর নির্ধারিত খরচসীমার বাইরে গিয়ে অন্য জ্বালানিতে রান্নাবান্নার কাজ করতে গিয়ে সংসার খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন অনেকে।

এদিকে দুই দফা তারিখ বদলের পর চলতি মাসে আমদানিকৃত এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হলে সংকট কমার যে আশা ছিল তাতেও গুড়ে বালি। এলএনজি সঞ্চালনের জন্য সাগরের তলদেশে তৈরি পাইপলাইনে ছিদ্র হয়েছে। সেটি মেরামত করতে অন্তত এক মাস সময় লাগবে। ঈদের আগে আর ওই গ্যাস গ্রিডে আসবে না। দেশিয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনাও নেই সরকারের। এই অবস্থায় আবাসিক গ্রাহকরা রান্নাবান্নার জ্বালানি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। দুশ্চিন্তায় পড়েছেন শিল্পপ্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টস কারখানা, সার কারখানা, সিএনজি স্টেশন এবং বাণিজ্যিক গ্রাহকরা। পাশাপাশি বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় গ্যাস পাচ্ছে না বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও।

পেট্রোবাংলা এবং দেশে সবচেয় বেশি গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানি তিতাস গ্যাস জানায়, এ বছরের শুরুর দিকেও সারা দেশে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি ছিল ৭০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু এ রমজানে শুধু তিতাসের আওতাধীন ঢাকাসহ ১৪টি জেলাতেই ঘাটতি ৭০ কোটি ঘনফুট। আর সারাদেশে এ ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১০ কোটি ঘনফুটে।

সরেজমিন ঘুরে ও গ্রাহকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ঢাকার কিছু এলাকায় গ্যাসের সমস্যা বছরজুড়েই রয়েছে। এ রমজানে ওই এলাকাগুলোতে সরবরাহ প্রায় বন্ধ। দিনের বেলা গ্যাস থাকে না। রাত ৯টা-১০টার পর চুলায় যে গ্যাস আসে তা দিয়ে নিভুনিভু চুলা জ্বলে। আবার রাত ১২টা-১টা নাগাদ গ্যাস বন্ধ হয়ে যায়। এ টিমটিম আগুনে রাত জেগেও রান্না শেষ করতে পারেন না গ্রাহকরা। আবার কিছু এলাকায় গ্যাস থাকে রাত ৩টা-৪টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত। কয়েকটি এলাকায় সারা দিন মৃদু গ্যাস সরবরাহ থাকলেও বিকাল থেকে ইফতার এবং সেহরির সময় গ্যাস নেই।

এই অবস্থায় রমজানের সেহরি-ইফতার তৈরি বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনযাত্রাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মুগদার বাসিন্দা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তৌফিকুল  ইসলাম বলেন, হোটেল থেকে কিনে এনে ইফতার ও এলপিজি চুলায় রেধে সেহরী সারছি। বংশালের আমিনা খাতুন জানান, কেরোসিন তেলের চুলার স্টোভে রান্নাবান্নার কাজ সারলেও আর্থিকভাবে ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারছে না তার পরিবার। উত্তর বাড্ডা এলাকার পূর্বাচল রোডের বাসিন্দা এহসানুল হক জসীম জানান, আগে থেকেই ওই এলাকায় গ্যাসের সরবরাহ কম থাকলেও এবার প্রথম রমজান থেকে গ্যাস সংকট প্রকট। পল্লবীর বাসিন্দা আসিফুর রহমান বলেন, চুলায় গ্যাস আসছে না। এলপিজি ও ইলেক্ট্রিক হিটার দিয়ে চলছে রান্নাবান্না।

রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে আশকোনা, ডেমরা, চানখারপুল, কামরাঙ্গীর চর, লালবাগ, হাজারীবাগ, মানিকনগর, ধলপুর, আজিমপুর, এলিফ্যান্ট রোড, কাটাবন, পল্লবী, কালশী, মিরপুর ১২, মিরপুর ১ ও ২, কাজীপাড়া, পশ্চিম মনিপুর, মাটিকাটা, ভাষানটেক, শংকর, লালবাগ, কাঁঠাল বাগান, দক্ষিণ বনশ্রী, পশ্চিম রামপুরা, বাড্ডা, নতুন বাজার, মগবাজার, মালিবাগ, বাসাবো, আদাবর, শ্যামলী, পশ্চিম আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, আদাবর, পশ্চিম ধানমন্ডি, হাতিরপুল ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, লালবাগ, সোবহানবাগ, পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার, কামরাঙ্গীরচর, উত্তরা, দক্ষিণখান, উত্তরখান, যাত্রাবাড়ীর একাংশে গ্যাস সংকট প্রকট রূপ নিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মশিউর রহমান বলেন, গ্যাসের চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম। তাই সংকট থাকলেও দূর করতে পারছি না। শিল্পকারখানা, সিএনজিসহ বিভিন্ন শ্রেণির গ্রাহকদের অনেকক্ষেত্রে পালাবদল করেও গ্যাস দেয়া হচ্ছে। কিন্তু রমজানে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ চাহিদা বেড়েছে। এ অবস্থায় এলএনজি আসলে সংকট কিছুটা কমবে। কিন্তু যে পরিমাণ আসছে তাতেও পুরোপুরি ঘাটতি দূর হবে না।

এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, রমজানে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্যাসের বেশি সংকট দেখা দিয়েছে। নির্দেশনা থাকলেও চাহিদা অনুযায়ী উত্পাদন না বাড়ায় বিতরণ কোম্পানিগুলো প্রয়োজনমত গ্যাস দিতে পারছে না। এলএনজি গ্রিডে আসার পর সমস্যা অনেকটাই কেটে যাবে।

২০১০ সালে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নেয় সরকার। বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এ ধরনের ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন ও আমদানি প্রক্রিয়া শুরু করতে গড়ে দুই বছর সময় লাগে। কিন্তু আট বছরেও বাংলাদেশ তা সম্পন্ন করতে পারেনি। গত ২৪ এপ্রিল ভাসমান টার্মিনাল (এলএসআরইউ) জাহাজ কক্সবাজারের মহেশখালীতে আসলেও তা সরবরাহ শুরু করতে পারেনি। সরকারের দায়িত্বশীল অংশ থেকে দুই দফায় মে’র প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে সরবরাহ শুরুর ঘোষণা দেয়া হয়।

সর্বশেষ ২৬ মে সরবরাহ শুরু হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু এখন এলএনজি সঞ্চালন শুরুর আগেই সমুদ্র তলদেশে এর পাইপলাইনে ছিদ্র দেখা দিয়েছে। আবহাওয়া প্রতিকূল থাকায় চার কিলোমিটার দীর্ঘ ওই পাইপলাইন নির্মাণে সময় লাগবে আরো প্রায় এক মাস। এ অবস্থায় আগামী জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের আগে এলএনজি জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন এলএনজি প্রকল্পটির তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানির এক শীর্ষ কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, এই টার্মিনালের দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে। তবে পরিমাণ গ্যাস গ্রীডে সরবরাহ করার জন্য সম্পূর্ণ পাইপলাইন এখনও নির্মিত হয়নি। ইতিমধ্যে নির্মিত পাইপলাইন দিয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। বাকি গ্যাস গ্রীডে আনতে আগামী বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় লেগে যাবে।

দৈনিকদেশজনতা/ আই সি

প্রকাশ :মে ২৬, ২০১৮ ১১:৫৪ পূর্বাহ্ণ