২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৯:৫০

ইরাকে অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনের প্রত্যাশা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

ইরাকের গত শনিবারের নির্বাচনকে কে কীভাবে নেবে, তা বিবেচনায় না নিয়ে একটি বিষয় নিশ্চিতভাবে বলা যায়- ইরাকি ভোটাররা সেখানে বিদ্যমান পরিস্থিতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং ক্ষমতা গ্রহণের জন্য নতুন রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

মোহমুক্ত সুন্নি ও শিয়া ভোটারদের সমর্থন লাভের চেষ্টাকারী বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল-আবাদি নিজের বেশিরভাগ ভোট হারিয়েছেন বিরোধী দুই জোট- জাতীয়তাবাদী শিয়া ধর্মপ্রচারক মোক্তাদা আল-সদরের নেতৃত্বাধীন ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ইসলামপন্থী, সেকুলার ও কমিউনিস্টদের জোট এবং হাদি আল-আমেরির নেতৃত্বাধীন ইরানপন্থী বিতর্কিত পপুলার মবিলাইজেশন ইউনিট (পিএমইউ) জোটের কাছে। হাদি আল-আমেরি আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পুরোভাগে ছিলেন; কিন্তু তার মিলিশিয়ারা নিনেভেহ ও সালাহ্উদ্দিন প্রদেশে সুন্নিদের বিরুদ্ধে নৃশংস অপরাধ সংঘটনের দায়ে অভিযুক্ত ছিল।

কম ভোটার উপস্থিতি এবং ভোট জালিয়াতির অভিযোগ (বিশেষত কুর্দি প্রদেশগুলোয়) সত্ত্বেও আল-সদরের আল-সেইরুন বা রেভুলুশনারিস ফর রিফর্ম অ্যালায়েন্সকে যারা ভোট দিয়েছেন, তারা মূলত ধর্মীয় গোষ্ঠীভিত্তিক রাজনীতিকে পরিহার করেছেন এবং ইরাক বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। মোক্তাদা আল-সদরের উৎফুল্ল সমর্থকরা নির্বাচনের পরদিনই বাগদাদ থেকে ইরানকে সরিয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, যা ছিল একটি চমক।

৪৪ বছর বয়সী আল-সদর হচ্ছেন এমন একজন দোদুল্যমান ও বিরুদ্ধ মত পোষণকারী নেতা, যার লাখ লাখ সমর্থক রয়েছে, বিশেষত দারিদ্র্যপীড়িত বাগদাদের আশপাশের এলাকায়। বর্তমানে ভেঙে দেয়া তার মিলিশিয়া গ্রুপ ২০০৩ সালের পশ্চিমা আগ্রাসনের পর মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। একসময় তিনি ইরানে আশ্রয় নেন; কিন্তু ইরানপন্থী বহুধাবিভক্ত রাজনীতির প্রকাশ্য বিরোধিতা করার জন্য ফিরে আসেন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকিকে সমর্থনহীন করেন।

আল-সদর ছিলেন সেসব নেতার একজন, যারা জাতিগত বিদ্বেষ-উত্তেজনা বৃদ্ধিকারী এবং সুন্নি, কুর্দি ও সংখ্যালঘুদের প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেয়া কোটা পদ্ধতির নিন্দা করেছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের যুগে দমন-পীড়নের বিরোধিতাকারী সম্ভ্রান্ত ধর্মীয় পরিবারের সন্তান মোক্তাদা আল-সদরকে এখন বিবেচনা করা হচ্ছে ইরাকের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিরোধী ইরাকি ও আরব জাতীয়তাবাদী হিসেবে

তিনি আল-মালিকির উত্তরসূরি হায়দার আল-আবাদিকে সমর্থন করেছিলেন, একই সঙ্গে তিনি পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, অবাধ দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন এবং আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। আল-সদরের বিজয় গুরুত্বপূর্ণ। বাগদাদে তার জয়ই বেশি হয়েছে, বেশি আসন তিনি পেয়েছেন এবং আরও অন্তত ৮টি প্রদেশেরও একই অবস্থা। যদিও তিনি বলছেন, রাজনৈতিক কোনো পদে তার আগ্রহ নেই, এখন তাকে দেখা হচ্ছে রাজা তৈরিকারী হিসেবে- এমন ব্যক্তি যিনি সিদ্ধান্ত দেবেন কে হতে যাচ্ছেন ইরাকের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।

যদিও আল-সদর বলছেন, তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে আল-আবাদিকে সমর্থন দেবেন; কিন্তু আবাদির একেবারে খারাপ ফল বড় একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দেবে। বর্তমানে যা পরিস্থিতি, তাতে কোনো পক্ষই এককভাবে সরকার গঠন করতে পারবে না। ফলে জোট গঠন করার জন্য সামনের কয়েক সপ্তাহ ব্যাপক আলোচনা ও দরকষাকষি দেখা যাবে, যাতে করে পার্লামেন্টে কর্তৃত্ব করার জন্য যথেষ্ট সমর্থন পাওয়া ও আস্থা ভোটে জয়লাভ করা যায়।

আল-সদর সম্ভবত এখনও আল-আবাদিকে সমর্থন করতে পারেন এবং তিনি সম্ভবত উদারপন্থী শিয়া নেতা আম্মার আল-হাকিমের নেতৃত্বাধীন আল-হিকমা মুভমেন্টের সমর্থনও পেতে পারেন। এ তিনজনের অবশ্য সুন্নি ও কুর্দি জোটগুলো এবং স্বতন্ত্রদের সমর্থন প্রয়োজন হবে। যদি তারা সফল হন, তবে ইরাকিরা শিগগিরই আমেরিকা প্রতিষ্ঠিত বিভক্তিমূলক রাজনৈতিক পদ্ধতির অবসান দেখতে পাবেন।

কিন্তু ইরানের হাতে এখনও অনেক মিত্র আছে, যারা আভির্ভূত হতে যাওয়া রাজনৈতিক শক্তিকে লাইনচ্যুত করতে কাজ করবে। ভোটে দ্বিতীয় হওয়া আল-আমেরির সমর্থন রয়েছে বেশিরভাগ দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশের কট্টর শিয়াদের মধ্যে। বলা হচ্ছে, পার্লামেন্টে জোট গঠনের জন্য আল-আমেরি এরই মধ্যে ইরানের লৌহমানব জেনারেল কাসেম সুলাইমানির পৃষ্ঠপোষকতায় আল-মালিকি ও আল-আবাদির সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। আল-আবাদি যদি আল-আমেরি ও আল-মালিকির সঙ্গে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন, তবে তিনি নিজের গ্রহণযোগ্যতাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবেন।

এসব সম্ভাব্য জোট গঠনের পেছনে প্রধান একজন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারেন নাজাফের শিয়া ধর্মীয় (মারজা) ইন্সটিটিউশনের প্রধান আয়াতুল্লাহ আলী আল-সিস্তানি। ইরাকি শিয়াদের মধ্যে তার প্রভাব সুবিদিত এবং তিনি আল-সদর ও তার মিত্রদের মাধ্যমে গঠিত মধ্যপন্থী জোটের উত্থানকে সমর্থন দিতে পারেন। আগে চেষ্টা করেছে এবং ব্যর্থ হয়েছে এমন ব্যক্তিদের সমর্থন না দেয়ার জন্য তিনি ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।

আল-সদরের সফলতা ইরাকে একটি নতুন বাস্তবতার ওপর জোর দিচ্ছে। আর তা হল ইরাকি জনগণের বড় একটি অংশ ধর্মীয় গোষ্ঠীগত (শিয়া, সুন্নি, কুর্দি) বিভেদের কারণে ক্রমশ ক্লান্ত এবং তারা স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার চান। এক্ষেত্রে আল-মালিকির রেকর্ড দুঃখজনক। তার শাসনামলে আইএস ইরাকের ৪০ শতাংশ দখল করে নিয়েছিল এবং বাগদাদ থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূর পর্যন্ত চলে এসেছিল। ফলে যে কোনো জোটে তার অবস্থান বিষবাষ্প ছড়াতে পারে। আল-আমেরি নিয়মিত ইরানের সমর্থনের ওপর নির্ভর করবেন এবং সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হলে তিনি বিরোধী জোটের প্রধান হতে পারেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এখনও গুরুত্বপূর্ণ রয়ে গেছে। ওয়াশিংটন ও আল-সদরের মধ্যকার শত্রুতার কারণে গোষ্ঠীগত বিভক্তি দূরীকরণে তার জোটের দৃঢ়সংকল্পকে ছায়াচ্ছন্ন করে ফেলা এবং দেশটিকে পুনর্গঠনের পথ থেকে সরিয়ে ফেলা উচিত হবে না। গত বছর তিনি (আল-সদর) সৌদি আরবের সংস্পর্শে এসেছিলেন। একই কাজ করেছিলেন আল-আবাদিও। তারা উভয়ে ইরাকের এ সংকট মুহূর্তে সবচেয়ে বড় আশা হয়ে রয়েছেন।

তবে ইরাক রয়ে গেছে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের অংশ হিসেবে। সর্বশেষ ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ায় আঞ্চলিক সংকট ও উত্তেজনা আরও ঘনীভূত হয়েছে। নিজেদের দেশ সম্পর্কে বেশিরভাগ ইরাকির প্রত্যাশা, আইএসের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থেকে উঠে দাঁড়ানোর পর তাদের দেশটি যেন আঞ্চলিক ঝগড়া-বিবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত না হয়।

প্রকাশ :মে ২৩, ২০১৮ ১:২১ অপরাহ্ণ