নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিচারবহির্ভূত হত্যা চলছেই। গত তিন দিনে ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ১২ জন। পুলিশ ও র্যাবের দাবি নিহতরা অপরাধী। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত চার মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৩ জন। যার মধ্যে ৬৯ জন নিহত হয়েছেন ক্রসফায়ারে। চলতি মাসে যে হারে ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটছে, তা অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ঘটনার সময় তাদের সদস্যরাও আহত হয়েছেন।
গত কয়েক দিনে যে সংখ্যক বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে তা আবারো বিষয়টিকে আলোচনায় নিয়ে এসেছে। গত দুই দিন ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে মানুষ ফের আলোচনা শুরু করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা এ নিয়ে মিডিয়াকর্মীদের নানা প্রশ্নের মুখে পড়ছেন।
বরিশাল সদর উপজেলায় গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অজ্ঞাত পরিচয়ে এক যুবক (৩৮) নিহত হয়েছেন। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে একটি পাইপগান, একটি রামদা, একটি চাপাতি, ৮ রাউন্ড গুলির খালি কার্তুজ উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ জানায়, শনিবার রাত ৩টায় শায়েস্তাবাদ সংলগ্ন নদীতে আলো দেখতে পেয়ে ডিবি পুলিশের একটি দলের সন্দেহ হয়। তারা কাছাকাছি এগিয়ে গেলে ডাকাত সদস্যরা ডিবি পুলিশকে ল্য করে গুলিবর্ষণ করে। এ সময় ডিবি পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। কিছু সময় পর ডাকাত সদস্যরা পালিয়ে যায়। পরে ঘটনাস্থলের পাশে একটি লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। বয়স আনুমানিক ৩৮ বছর। ওসি বলেন, এ ঘটনায় ডিবি পুলিশের এসআই দেলোয়ার, কনস্টেবল রফিক ও হাফিজ আহত হন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এ দিকে শায়েস্তাবাদ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আরিফুজ্জামান মুন্না জানান, নিহত ডাকাত সদস্যকে স্থানীয়রা কেউ চিনতে পারেননি। তবে কয়েক দিন আগে আবদুল হক হাওলাদারের বাসায় যে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে সে সময় এ যুবককে তিনি দেখেছিলেন বলে জানিয়েছেন।
ময়মনসিংহে পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বিপ্লব নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। শনিবার রাতে শহরের চরপাড়া এলাকায় গনসার মোড়ে এ ঘটনা ঘটে। ময়মনসিংহ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: আশিকুর রহমান জানান, বন্দুকযুদ্ধের সময় পুলিশ কনস্টেবল রাশেদুল ও কাওছার আহত হন। তাদের ময়মনসিংহ পুলিশ লাইনস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ফেনীর ছাগলনাইয়ায় পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আলমগীর হোসেন (৩২) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। নিহত আলমগীর উপজেলার চিহ্নিত মাদক বিক্রেতা বলে দাবি পুলিশের। শনিবার রাত দেড়টায় উপজেলার পাঠাননগর ইউনিয়নের পশ্চিম পাঠাননগর এলাকায় এ ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়। ছাগলনাইয়া থানার পরিদর্শক এম মোর্শেদ গণমাধ্যমকে বলেন, আলমগীরের বিরুদ্ধে ছাগলনাইয়া থানায় বিভিন্ন অভিযোগে ৯টি মামলা রয়েছে। সে উপজেলার চিহ্নিত ইয়াবার ডিলার ও ফেনসিডিল কারবারি ছিল।
দিনাজপুরের বিরলে পুলিশের সাথে বন্দুুকযুদ্ধে গালকাটা বাবু (৪০) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন আরিফুল ও শহিদুল ইসলাম নামে পুলিশের দুই সদস্য। পুলিশের দাবি, বাবু কুখ্যাত মাদক কারবারি । শনিবার রাতে যশোরে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন আরো এক যুবক। স্থানীয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তবে নিহতের নাম পরিচয় জানা যায়নি।
গত শনিবার যশোর ও ময়মনসিংহে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে এক রাতে চারজন নিহত হয়েছেন। যশোর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সালাহউদ্দিন সিকদার মিডিয়াকে বলেছেন, শনিবার ভোরে অভয়নগরের বাগদা মাঠে র্যাব ৬-এর সাথে গোলাগুলিতে তিনজনের মৃত্যু হয়।
এ দিকে নওয়াপাড়া পৌর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিম শেখ অভিযোগ করেছেন, তার বড় ভাই হাবিবুর রহমান শেখসহ (৪২) তিনজনকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার দাবি, বৃহস্পতিবার তাদের যার যার বাড়ি থেকে সাদা পোশাকে র্যাব পরিচয়ে ধরে নেয়া হয়। এরপর কোথাও তাদের খোঁজ মেলেনি। শনিবার সকালে তাদের মৃত্যুর খবর পাই। নিহত অন্য দুইজনের নাম সুমন পাটোয়ারি (৪৪) ও আবুল কালাম (৪৭) বলে জানান তিনি।
অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শেখ গণি মিয়ার দাবি, ‘নিহত তিনজন সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারের সাথে জড়িত ছিলেন।’
ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলায় গ্রেফতারের পর কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা মামলার এক আসামির মৃত্যু হয়েছে। নান্দাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম মিয়া জানান, উপজেলার চৌরাস্তাা কলাপাড়া এলাকায় শুক্রবার রাতে গোলাগুলির এ ঘটনা ঘটে। নিহত মোহাম্মদ ইমন (১৯) উপজেলার বনুড়া গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে দুই জেলায় র্যাবের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তিনজন নিহত হয়েছেন। র্যাবের দাবি, নিহতরা মাদক কারবারি। চট্টগ্রাম নগরীর রেলস্টেশনের পাশে সদরঘাট থানার আইস ফ্যাক্টরি রোডে র্যাবের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। র্যাবের দাবি, মাদকের আখড়া হিসেবে কুখ্যাতি পাওয়া বরিশাল কলোনিতে র্যাবের অভিযানে দুই মাদক কারবারি নিহত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ৪নং বাঁধঘাট এলাকায় র্যাবের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একজন নিহত হয়েছেন। এ সময় অস্ত্র, গুলি ও বিপুল পরিমাণ গাঁজা উদ্ধার করা হয়। র্যাবের দাবি নিহত ব্যক্তি একজন শীর্ষ মাদক কারবারি।
রাজনৈতিক অঙ্গনেও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী গতকাল বলেছেন, সারা দেশে বন্দুকযুদ্ধের নামে মারণযজ্ঞ চলছে। গত তিন দিনে চার জেলায় বিচারবহির্ভূত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে সাতজন। এ মাসে যেন পোকামাকড়ের মতো বিচারবহির্ভূত মানুষ হত্যার হিড়িক চলছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি) অভিযোগ করেছে, সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৩ জন। যার মধ্যে ৬৯ জন নিহত হয়েছেন ক্রসফায়ারে। বিচারবহির্ভূত হত্যা চলতি মাসে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়াবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, মাদকবিরোধী অভিযান চলছে দেশজুড়ে। এ অভিযানের সময় কোথাও কোথাও দুর্বৃত্তরা আক্রমণ করে বসে। তখনই এ ঘটনা ঘটছে। এ অভিযানে গত ১৬ দিনে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৮ জনের মৃত্যুর খবর রয়েছে ।
দৈনিক দেশজনতা/ টি এইচ