২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৪:৫৪

“আজ রাতে বাড়িতে আসতে পারবি না…! বুঝলাম ১৪৪ ধারা জারি হয়ে গেছে!!

অনেকদিন থেকে ভাবছি মা’কে নিয়ে লিখবো কিন্তু লেখাই হয়না। মায়ের প্রতি ভালোবাসা দিবসের ফ্রেমে বাধা যায় না, তারপরও আজ লিখতে বসলাম।
তাঁর সকল বিষয়/অবদান উল্লেখ করার না আমার সক্ষমতা আছে আর না আদৌ শেষ করা যাবে। তবুও কিছুটা লেখার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।

মান-অভিমান, ভালোবাসা

ছোট বেলার একটা ঘটনা দিয়েই শুরু করি। একবার কোন একটা কারণে মায়ের প্রতি আমি খুবই রাগন্বিত হয়ে তাঁর কথার প্রতিউত্তর করি এবং তা অনেকটা গালির পর্যায়ে চলে যায়। ওরে মা রে! কোথায় যাই এবার! মা তো রেগে ফুলে অগ্নিশর্মা। আমিও বুঝতে পারলাম কী ঘটতে যাচ্ছে। আমি ভো দৌড় দিয়ে পালিয়ে গেলাম। আর যাওয়ার পথে শুনতে পাচ্ছি তাঁর চিৎকার “আজ রাতে বাড়িতে আসতে পারবি না…। বুঝলাম ১৪৪ ধারা জারি হয়ে গেছে আমার বিরুদ্ধে!
এ আইন তো আর বাংলাদেশি আইন না এ আইন তাঁর (মায়ের) মোবাইল কোর্টের আইন! সন্ধ্যা হল কিন্তু ভয়ে বাড়িতে ঢুকতে পারছি না। এমন পরিস্থিতিতে পাশে এসে দাঁড়ালো দাদী। সে অভয় দিল কোন সমস্যা হবে না, রাতে তার (দাদীর) সাথে থাকা যাবে। উপায় না পেয়ে রাজি হয়ে গেলাম।

কিন্তু কোন ভাবেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। কারণ, মা যতই রাগী হন না কেন, রাতে সেই আমাকে তাঁর বুকে মাথা টেনে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, আর আমিও তাাঁর কোলে মাথা না রেখে ঘুমোতে পারি না। রাতে সেই কবিতা, গান, গল্প শুনিয়ে পিঠ চাপড়ে না দিলে ঘুম আসতো না। গরমের রাতে সেই ছিল বিদ্যুৎহীন পাখা। রাতে সেই পায়ে তৈল দিয়ে পা মালিশ করে দেয়। যাইহোক দাদী তো আর এগুলো করছে না, ঘুমও আসছেনা। আবার ভাবছি মা যদি আর কোনদিন না ডাকে, যদি আর বাড়িতে না উঠতে দেয়! নানান ভাবনা চিন্তার দোলাচালে শুয়ে শুধু এপিঠ-ওপিঠ করছি। এরপর এক পর্যায়ে আর সহ্য করতে না পেরে কাঁদতে শুরু করলাম। আর নির্লজ্জের মত মা মা করে ডাকতে শুরু করলাম।

ওদিকে মা নিজেও আমার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। সেও অনুতপ্ত হয়েছে। সেও ভাবছে এতো কঠোর না হলেও পারতাম। আমি একঘরের বারান্দায় আর মা ঠিক তার বিপরীত পাশের ঘরের বারান্দায় আমার অপেক্ষায় বসে আছে। যখনই আমার কান্নার আওয়াজ পেয়েছে তখনই সে যেন তার দেহে প্রাণ খুঁজে পেয়েছে। তাঁর বুঝতে বাকি নেই যে, তাঁর ভালবাসা কঠোরতার ঊর্ধ্বে। কিন্তু তারপরও সে নিজেকে সামলে নিয়েছে যেন আমি দ্বিতীয়বার এধরণের ভুল আর না করি। সে বললো, ঘরে উঠতে হলে নাকেখর দিতে হবে এবং কথা দিতে হবে যেন দ্বিতীয়বার আর এ ভুল না হয়। আমি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম। কারণ, আমি জানি তাকে ছাড়া আমি এক মুহূর্ত থাকতে পারব না। এরপর সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তাঁর কোলে মাথা রেখেই সেই রাতে ঘুমোতে গেলাম। (এ ঘটনাটা মা প্রায়ই বলতেন এমনকি এখনও বলে)।

আমার এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে মা তৈল দিয়ে পা মালিশ করে দিচ্ছে আর আমি আরাম পাচ্ছি আবার ক্ষণেক্ষণে মা চালাকি করছে আর আমি সুড়সুড়ি পাচ্ছি আর পা টান দিচ্ছি। আমার মনে পড়ছে মা কবিতা পড়ছে- হা রে রে ঐ যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে , তুমি যাচ্ছ পাল্কিতে মা চড়ে আমি যাচ্ছি ঘোড়ায় চড়ে তোমার পাশে পাশে… মাগো আমার শোলক বেলার কাজলা দিদি কই?… এক দেশে ছিল এক রাজা…, একবার ইউসুফ নবীকে জঙ্গলে ফেলে দেয় তার ভাইয়েরা…, ইসমাইল নবীকে তার বাবা ইব্রাহীম নবী কুরবানি করতে নিয়ে গেলেন… ইত্যাদি। তিনি বলতেন আর আমি গভীর আগ্রহে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আর কখনো ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম আবার কখনো হাসতাম কখনো বা কান্নাও পেত। অর্থাৎ- প্রতিটি রাতই ছিল একটা নতুন কিছুর সাথে পরিচয়, একটা নতুন এপিসোড।

মা কঠোর হলেও তাঁর সাথে বিনোদনও করতাম। প্রায় বিকালে তার মাথার চুল আঁচড়িয়ে দিতাম, বটে দিতাম আবার মাঝে মাঝে দুষ্টুমি করে গিট্টি দিয়ে দিতাম কিন্তু তাতে কাজ হত না। আজও যেন আমি ঐ কালো চিরুনি আর মায়ের ঐ নরম চুলের স্পর্শ অনুভব করছি। যখন দেখতাম মা বসে আছে তখন বলতাম “দেখেনতো আমার মাথায় উকুন আছে কিনা?” আসলে উদ্দেশ্য ছিল যাতে মা মাথার চুলগুলো টেনে দেয়। মা’ও বুঝতো কিন্তু তারপরও সে ভালবেসে চুল টেনে দিত।

মা ছিল একজন শিক্ষক

থালা-বাসন পরিষ্কার থেকে শুরু করে ধর্মীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রথম সেই সবচেয়ে বেশি দিয়েছে। আমরা দুই ভাই যখন ছোট তখন মা আমাদের নামাজ শিক্ষার বিষয়ে খুবই তৎপর ছিলেন। সাধারণত দিনের বেলায় মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে সমস্যা হত না। আবার ফজরের নামাজে আব্বাই (আব্বা শব্দটি আমার মায়ের শেখানো তাই এটি বলতেই ভালবাসি) সাথে নিয়ে যেত। কিন্তু সমস্যা ছিল এশার নামাজে। তাই মা তখন একটি হারিকেন/ ল্যাম্প (স্থানীয় ভাষায় বাতি বিশেষ) নিয়ে আমাদেরকে মসজিদের দিকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য গেইট পর্যন্ত আসতেন। আমরা দুজন মসজিদে গিয়ে চিৎকার দিতাম যে আমরা পৌছে গেছি (মসজিদ বেশি দূরে ছিল না)। তখন দেখতাম ঐ আলোটা আস্তে করে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেছে। আমরা বুঝতাম মা ভিতরে চলে গেছে। এরপর নামাজ শেষ হলে আবার আমরা মা বলে ডাক দিতাম। দেখতাম একটা আলো বাড়ির ভিতর থেকে বের হয়ে আসছে। বুঝতাম মা চলে এসেছে। আসলে সে আমাদেরকে পাঠিয়ে অপেক্ষা করতো। এরপর ঐ আলোকে কেন্দ্র করে দুজনে দৌড় দিতাম।

ফজরের নামাজের পর আব্বা-মা দুজনই কোরআন ও হাদিস পড়তে বসতো। আমাদেরও পাশে বসাতো। আমরা কোরআন পৃথক পৃথকভাবে পড়ার চেষ্টা করলেও হাদিস একজনই পড়তো, আর বাকিরা শুনতো। আর বেশিরভাগ সময় মা’ই হাদিস পড়তো। কারণ, মায়ের পড়া ছিল স্পষ্ট আর আব্বার পড়া ছিল অস্পষ্ট। ফলে আব্বা পড়লে মা প্রায়ই ভুল ধরতেন। যে কারণে আব্বা মায়ের সামনে পড়ার ঝুঁকি নিতেন না। তবে ব্যাখ্যা করতেন আব্বা। এদিকে আব্বা মায়ের থেকে উপরে ছিলেন। আর এটা মা’ও মেনে নিতেন। আবার কোরআন পড়ার ক্ষেত্রে আব্বা ছিল মায়ের উস্তাদ।

যাইহোক মকতবে পাঠানোর পাশাপাশি মা নিজেও আমাদের কোরআন ও নামাজ শিক্ষা দিতেন। আর এভাবেই তিনি ধর্মীয় শিক্ষা দেন। যেহেতু তখন আমাদের কোন বোন ছিল না, আবার আব্বাও সকালে বাজারে যেতেন আর রাতে ফিরতেন তাই মা’কেই বাড়ির সকল কাজ করতে হত। আর এ কারনেই সে সকালে আমাদের বিছানা, টেবিল, আলনার কাপড়…ইত্যাদি গুছিয়ে দিতেন আর বলতেন রাতে ঘুমনোর আগ পর্যন্ত যেন এমনই থাকে। আমরাও যথাসম্ভব তা পালন করার চেষ্টা করতাম। কারণ, পাছে যদি ভ্রাম্যমাণ আদালতে শাস্তি হয়ে যায়!

ছোটবেলায় নিয়মিত আর একটু বয়স হলে বিশেষ দিনে তিনি আমাদের গোসল করাতেন। আর ঐদিন ছিল আমাদের পাতিলের মত অবস্থা। না কান্না করা পর্যন্ত ঘষাঘষি চলতো। কান্না ছিল তার মানদণ্ড। অর্থাৎ এ পর্যন্ত আসলে সে বুঝতো কাজ হয়েছে। অন্যদিকে স্কুল, মাদ্রাসা, আত্মীয়বাড়ি…ইত্যাদি জায়গায় যাওয়ার সময় তার নির্ধারিত ড্রেস বা ফ্যাশনই ছিল একমাত্র ফ্যাশন। এমনকি চিরুনি পর্যন্ত সে নিজে করে দিত।

যাইহোক তিনি আমাদের ছোট বড় সকল কাজ শেখাতেন। খাওয়ার আদব থেকে শুরু করে বড়দের সাথে ব্যবহার। হাতের নখ কাটা থেকে রোদে কাপড় শুকানোতে যে একটা সৌন্দর্য আছে তাও তিনি শেখাতেন। এ বিষয়ে সে আব্বাকে প্রায়ই কথা শুনাতো। ঘরের আসবাবপত্র প্রতি ৩/৪ মাস পরপর স্থানান্তর করতেন। তাতে যেন এক নতুনত্ব প্রকাশ পেত। অর্থাৎ তিনি যে একজন রুচিশীল বা সৌন্দর্যপ্রেমী মানুষ তাতে সন্দেহ নেই।

নিজেরা নিজেদের জিনিস ঠিকমতো গুছিয়ে রাখার পাশাপাশি তাঁকেও তাঁর কাজে আমরা সাহায্য করতাম। সন্ধ্যায় একটা নিয়মিত কাজ ছিল হ্যারিকেন পরিষ্কার আর ঘর বারান্দা ঝাড়ু দেওয়া। আমি একটা করলে ভাই করতো অন্যটা। রান্নার আগে ও পরে তাঁকে সাহায্যা করতাম। একটু বড় হলে নিজেদের কাপড় নিজেরাই পরিষ্কার করতাম। এভাবে তিনি আমাদেরকে যেমনি পরিষ্কার থাকার শিক্ষা দিতেন তেমনি স্বনির্ভরতার শিক্ষাও দিতেন। যার সুফল পাচ্ছি এখন পদে পদে।

তিনি ছিলেন একজন বুনন শিল্পী। হয়তো এটি তিনি পেয়েছেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে অর্থাৎ আমার নানীর কাছ থেকে। কাঁথা সেলাই থেকে শুরু করে প্রায় সব সেলাই তিনি পারেন। আমরাও তাঁর থেকে এর কিছু অংশ না শিখতে ভুল করিনি। এক্ষেত্রে তিনি আমাদের উস্তাদ।

তিনি একজন ডাক্তার বা হাকিম। যে কোন ধরনের রোগে পড়লে তিনি মানসিক সান্ত্বনা থেকে শুরু করে ঔষধি খাবার, ঔষধ ও ডাক্তারের খোঁজে ব্যাকুল থাকেন। আমার এখনো মনে পড়ে, জ্বর হলে মা কলসের তলায় ছিদ্র করে তাতে পাটকাঠি দিয়ে লাইন করে দিত, যার ফলে কলসে ভরা পানি আস্তে আস্তে মাথায় এসে পড়তো। এ যেন এক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার! আবার ঠাণ্ডা লাগলে রাতে তৈল দিয়ে পা মালিশ করে দিত।

আব্বা যখন মা’কে সার্টিফিকেট দেয়

মা হলেন সকল কাজের কাজী। যেখানে আমরা পর্যন্ত হিমশিম খাই সেখানে এক মণ/দেড় মণ ওজনের চাল/ধানের বস্তা অনায়াসে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে নিয়ে যাওয়া তাঁর জন্য কোন বিষয়ই না।যদিও তাঁকে দেখে মনে হয় সে হয়তো দশ কেজিও উচু করতে পারবেনা! মানুষ কাজ করার ফলে অসুস্থ হয় আর আমার দেখা এই একটা মানুষ যে কাজ না করলে অসুস্থ হয়ে যায়।

তিনি একজন উদ্যোক্তা। বাড়ির আসবাবপত্র থেকে শুরু করে মাঠে বাজারে জমি ক্রয় পর্যন্ত উদ্যোগও তিনি নিতেন বা আব্বার প্রস্তাবে তিনিই সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট/ সাহস যোগাতেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য তিনিই ছিলেন অগ্রনায়ক। আব্বার বড় বড় পরিকল্পনা গুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মা নানান জায়গায় দৌড়ে বেড়িয়েছেন। আর এ ক্ষেত্রে নানাদের সহযোগিতা ছিল অপরিমেয়। আমরা কৃতজ্ঞ। মা যদি বলতেন এ কাজটা সে করবে তাহলে ধরে নিতে হবে কাজটি হয়ে গেছে। কারণ, যত রাতই হোক সে ঐ কাজটা না করে ঘুমাতে যেতেন না। আব্বা মোটামুটি ধৈর্যশীল আবার ঢিলেমি স্বভাবেরও বটে। আব্বার থেকে আমার এ গুণ হয়তো পুরোপুরি এসেছে আর মা’র থেকে এসেছে উদ্যোক্তা হওয়ার গুণ। যাইহোক মা ছিল আব্বার ঢিলেমি স্বভাবের সম্পূর্ণ বিপরীত।

তিনি শুধু উদ্যোগ নিয়েই বসে থাকতেন না, আব্বার সাথে নিজেও দৌড়েছেন। তাঁর জায়গা থেকে যতটুকু সম্ভব তাঁর চেয়েও ঢেঁর বেশি করতেন। থালা বাসন ধোয়া থেকে শুরু করে পর্দায় থেকে বাড়িতে নারী পুরুষের কাজ সমানে পাল্লা দিয়ে করেছেন। ঘরে খাবার বাড়ন্ত থাকলে দেখেছি মা কখনো অর্ধাহারে আবার কখনো অনাহারে দিন কাটাতে। ছেলে মেয়েদের পোশাকের ব্যাপারে তাঁর আগ্রহের শেষ থাকে না কিন্তু কখনো শুনিনি মা বলেছে তাঁর একটা কাপড় লাগবে! হয়তো বলতো তাঁর কাপড়টা অনেক পুরাতন হয়ে গেছে। বরঞ্চ আব্বাই উৎসুক হয়ে এনে দিত। আল্লাহর রহমতে তাঁর হাত ধরেই একটি অসচ্ছল পরিবার সচ্ছলতার মুখ দেখতে সক্ষম হয়েছে। এজন্য আব্বা প্রায়ই বলেন, এ সংসারের আজ এ পর্যন্ত আসতে তোদের মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি।

আব্বার প্রতি মায়ের ভক্তি, ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও ভয়

অন্যায়ের বিষয়ে মা ছিল আমার দেখা শ্রেষ্ঠ আপোষহীন ব্যক্তি। অন্যায় করে ফেললে আব্বা পর্যন্ত ভয়ে থাকতো। এ বিষয়ে নানা বাড়িতেও তাঁর নাম ডাক আছে। কিন্তু আব্বার প্রতি তাঁর ছিল অগাধ ভক্তি, ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও ভয়। আমি খেয়াল করে দেখতাম, বাসায় যখন ভাল কিছু রান্না হত, মা তখন আব্বার জন্য আগেই কিছু রেখে দিত। মা বলতো, সে সারাদিন বাহিরে থাকে, অনেক কষ্ট করে, আবার সবার শেষে খায় তাই তাঁর জন্য ভালোটা না রাখলে তাঁর মন খারাপ হতে পারে।
আবার আব্বার ময়লা কাপড় যদি রেখে দিত আর মা যদি তা পরিষ্কার করতে ভুলে যেত তাহলে মাঝে মধ্যে আমাদের সামনে বলেই বসতো “তোর আব্বা আমাকে যে কী বলবে!”

অথচ কোনদিন আমি শুনিনি আব্বা না খাবার নিয়ে মা’কে কিছু বলেছে আর না কাপড় পরিষ্কারের জন্য বকেছে। বরং খাবার না থাকলে দেখেছি আব্বা কোন কথা না বলে ভাতের পরিবর্তে মুড়ি, চিড়া ইত্যাদি খেয়েছে। আবার গরম ভাতের পাশাপাশি যদি পান্তাভাত থাকতো তাহলে আব্বা আগে পান্তা ভাতই খেত। আবার মা অসুস্থ থাকলে তিনিই মাঝে মাঝে রান্নার উদ্যোগ নিতেন।

অন্যদিকে কাপড় পরিষ্কারের বিষয়ে যদি মা পরিষ্কার না করতো বা ভুলে যেত তাহলে আব্বা নিজেই কাপড় ও সাবান হাতে নিয়ে পরিষ্কার করতে বসে যেত। অর্থাৎ আব্বার দোষ ত্রুটি যেমন তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন আবার নিজের ভুল হলে লজ্জা ও ভয়ে থাকতেন যা ছিল ভক্তি ও শ্রদ্ধা মিশ্রিত!

মায়ের স্বপ্ন

মা’কে অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় বলে তাঁর শিক্ষা অর্জনের স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে যায়। তাই সে সেখান থেকে সংকল্প করে তাঁর সন্তানদেরকে শিক্ষিত করে তাঁর এই অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরন করবে। আজ সে গর্বের হাসি হাসে কারণ, আজ তার দুই ছেলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছে।

আমরা ছাড়া মা

মা অত্যন্ত কঠোর হলেও যেদিন বড় ভাই পড়ালেখার জন্য বাইরে আসলেন সেদিন থেকে সে আমাদের প্রতি দূর্বল হতে শুরু করল। আর তখন থেকে মা আমার প্রতিও কিছুটা সহনশীল হন। হয়তো সে আমাকেও ছেড়ে দেওয়ার দিন গুণতো। যাইহোক আমিও যখন বাড়ি ছাড়লাম তখন মা মানসিকভাবে আরো বেশি দূর্বল হয়ে পড়লো।
আজ মা আছে এক শান্ত পল্লী গাঁয়ে আর আমি আছি এক ব্যস্ত নগরীতে তাঁর থেকে অনেক দূরে। যখন আমি বাড়িতে যাওয়ার দিন দিই তখন মা দিন গুণতে থাকে, তাঁর সমস্ত দুঃখ শেষ হয়ে যায়, অসুস্থতা দূর হয়ে যায়। আর যেদিন আমি ফিরে আসার দিন বলি সেদিন থেকে মা’র মুখটা মলিন হয়ে যায়, আবার অসুস্থতা, দুঃখ, চিন্তা তাঁকে ঘিরে ধরে। বিদায় কালে সে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। যখন আমি বাড়ি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে বের হয় তখন বাসা থেকে মা, বাবা, ভাই, বোন, চাচা, চাচী, দাদী,ফুফু… অনেকেই আসে বিদায় দিতে। মাঝে মাঝেই আমি মায়ের চোখের দিকে তাকাই। দেখি তাঁর চোখ অশ্রুসিক্ত। কিন্তু সে আঁচল দিয়ে তা এমনভাবে মুছতে থাকে যেন আমি মনে করি তার চোখে হয়তো কিছু গিয়েছে। কিন্তু আমার তো আর তাঁর চালাকি বুঝতে ভুল হয়না। আমার তখন এক প্রকার হাসি পাই, আর সে হাসি যে কীভাবে হাঁসতে হয় তা আমি বুঝাতে পারি না।

আমি যতবার পিছন ফিরে তাকায় ততবার দেখি তাঁর পাশ থেকে একে একে সবাই চলে যাচ্ছে আর সে পলকহীন চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। আর মাঝে মাঝে ওড়নার পাড় দিয়ে চোখটি এমন ভাবে মুচছে যেনো আমি বুঝতে না পারি। একটা মোড়ে গিয়ে আমার আর তাঁর মাঝে শেষবারের মত দেখার সুযোগ হয়। আমি দু পা পিছিয়ে আবার পিছন দিকে তাকাই। দেখি মায়ের পাশে আর কেউ নেই। সে নিজেকে আর সামাল দিতে না পেরে গাছের সাথে হেলান দিয়ে অনেকক্ষণের চাপা কান্না তৃপ্তি সহকারে বের করে দিচ্ছে। কারণ তখন তাঁর আর এই ভয় নেই যে আমি দেখে ফেলবো আর আমার মন খারাপ হয়ে যাবে। সে চায়না তাঁর প্রিয় মানিক এতটুকু কষ্টও তাঁর থেকে পাক! আর মা’কে শেষবার দেখার পর আমিও আমার চাপা কান্না ঠেকাতে পারি না। মনের অজান্তেই চোখ লাল হয়ে যায়, বেয়ে পড়ে অশ্রু। আবার তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিই। কারণ, আমি জানি সে আমাকে কাঁদতে পাঠাইনি, জয় করতে পাঠিয়েছে!!!

চলে আসার পর আমার ফেলে আসা জিনিস গুলো, পড়ার চেয়ার টেবিল, কখনো বা আমার সাথীদের দেখে ছুটে চলে যায় তাদের কাছে। কিন্তু পিছন থেকে কেউ যেন বলে তোমার ছেলে ওইখানে নেই। তখন তাঁর বুকটা হাহাকার করে ওঠে, চোখ দুটি অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়, ফিরে আসে না পাওয়ার বেদনা নিয়ে । বাড়ি থেকে আসার সময় তাঁকে বলে আসি “এই তো কিছু দিন পরই আসছি” তখন তাঁর অপেক্ষার পালা আবার শুরু হয় কিন্তু আমার ব্যস্ততা শেষ হয় না, তাঁর সাথে দেখাও মেলে না।

হয়তো একদিন আমার সকল ব্যস্ততা দূর হবে কিন্তু সে আর আমার জন্য অপেক্ষা করবে না, দিনও গুণবেনা, মোবাইলে আর কলও দিবে না, আমাকে কাছে পেয়ে হাতে- কপালে চুমুও দেবে না কিংবা বিদায় কালে চোখের পানি মুছবেনা । সেদিন আমি তাঁর কাছে যাবো-আসবো কিন্তু তাঁর ওড়না দিয়ে চোখের জল মুছবার ব্যর্থ চালাকিও দেখবো না, শুধু আমার হাত পকেটে থাকা রুমালটাকেই স্পর্শ করবে । থাক! আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারছি না । মা, মাগো, দোয়া কর যেন, সেখানে গিয়ে দুজন একত্রিত হতে পারি যেখানে কারো কোনো ব্যস্ততা থাকবেনা চির সুখের ‘জান্নাতে’ । সালাম ‘মা’ ভলো থেকো আর দোয়া কর যেন তোমার ও আমার মনের আশা পূরণ করতে পারি।

ইসমাইল হোসেন
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশ :মে ১৩, ২০১৮ ১১:৫৮ পূর্বাহ্ণ