নিজস্ব প্রতিবেদক:
সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে বিপুল অর্থ সংগ্রহে সরকারের অব্যবস্থাপনা শিগগিরই দূর হচ্ছে না। নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণেই সরকারকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি করতে হচ্ছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা প্রতিবছরই দ্বিগুণ ছাড়িয়ে এমনকি তিন গুণের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে।
আপাতত মতে হতে পারে, ভালোই তো, সরকার টাকা পাচ্ছে, গ্রাহকও পাচ্ছে মোটা অঙ্কের সুদ। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে এর চাপটা পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। কারণ, সাধারণ মানুষের করের টাকায় সরকারকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ সুদ গুনতে হচ্ছে। আবার হিসেবি ও নির্ঝঞ্ঝাট মানুষেরা ব্যাংক থেকে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) ভাঙিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনছেন বলে ব্যাংকের তহবিলেও টান পড়ছে। অন্যদিকে সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনায় তৈরি হচ্ছে বড় ধরনের ঝুঁকি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ৬০ হাজার ১২৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। মাসিক গড় বিক্রি ৬ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। সে হিসাবে বাকি তিন মাসে আরও বিক্রি হওয়ার কথা ২০ হাজার কোটি টাকা। অথচ পুরো অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকারের নিট সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।
তবে ৯ মাসের মোট বিক্রি থেকে নিট বিক্রি হয়েছে ৩৬ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। বাকি টাকা আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মূল ও মুনাফা পরিশোধে খরচ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত দুটি কারণে সঞ্চয়পত্রের এই দেদার বিক্রি। প্রথমত, গ্রাহকদের কাছে অর্থের উৎস জানতে চাওয়া হয় না। দ্বিতীয়ত, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার যেকোনো আমানতের সুদের হারের চেয়ে অনেক বেশি। সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের সুদ দিতে চলতি অর্থবছরে ১৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা আছে।
আগের অর্থবছরে এ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু কাদের কাছে বিক্রি হচ্ছে সঞ্চয়পত্র? তাঁদের বেশির ভাগ কি সাধারণ মানুষ? এমন প্রশ্নের জবাবে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘না। সরকারি বড় পদের কর্মচারী, রাজনীতিবিদ ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই সঞ্চয়পত্র বেশি কিনছেন। করের টাকায় বিপুল অঙ্কের এই সুদের বরাদ্দও তাঁদের জন্যই।’
সমাজের কোন কোন শ্রেণি নামে-বেনামে সঞ্চয়পত্র কিনছে, এ ব্যাপারে সঞ্চয় অধিদপ্তরের কাছে তথ্য নেই। ভালো একটি তথ্যভান্ডার তৈরির চেষ্টাও নেই এই অধিদপ্তরের। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শামসুন্নাহার বেগম গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি নতুন এসেছেন। তবে পুরো খাতের সংস্কারের কাজ চলছে। অর্থ বিভাগে পাঠানো এক প্রস্তাবে সঞ্চয় অধিদপ্তর বলেছে, যুগ্ম নামে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বন্ধ করতে হবে এবং নাবালকের নামে ও প্রতিষ্ঠানের কাছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা যাবে না। বিক্রির উচ্চসীমাও ৫০ লাখ থেকে কমিয়ে আনতে হবে ৩০ লাখ টাকায়। এ প্রস্তাব কার্যকরে হাত দেয়নি সরকার।
অর্থ বিভাগে নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটি (সিডিএমসি) নামে একটি কমিটি রয়েছে। কার্যবিবরণীতে দেখা যায়, সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি তৈরি করছে সঞ্চয়পত্র, এতে ব্যয়ও বাড়ছে। তবে অনেকেই বলছেন, যেহেতু এটি সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর বিষয়, তাই এতে সংস্কার আনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ প্রজ্ঞা ও সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
বৈঠকে ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত সরকারের পাঁচ বছরের অভ্যন্তরীণ ঋণের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে বলা হয়, ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকেই ব্যাংক খাত থেকে সরকার কম ঋণ নিচ্ছে, বেশি নিচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে। পাঁচ বছর আগে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের ৬৬ শতাংশ ব্যাংক খাত থেকে আসত, বর্তমানে তা নেমে এসেছে ৪৪ শতাংশে। অন্যদিকে পাঁচ বছর আগে অভ্যন্তরীণ ঋণের ৩৪ শতাংশ আসত সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে, বর্তমানে এই হার ৫৬ শতাংশ।
সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ট্রেজারি বন্ড থেকে অর্থ নেওয়ার সুপারিশ করা হয় সিডিএমসির বৈঠকে। বলা হয়, ট্রেজারি বন্ড অপেক্ষা সঞ্চয়পত্রের সুদ গড়ে ৫ শতাংশ বেশি। সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ মেয়াদ ৫ বছর হলেও ট্রেজারি বন্ডের মেয়াদ ২ থেকে ২০ বছর। দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কম ঝুঁকিপূর্ণ হলেও বেশি নেওয়া হচ্ছে স্বল্পমেয়াদি ঋণ। কার্যবিবরণীতে বলা হয়, সরকার কম সুদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণ না নিয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অর্থাৎ বেশি সুদের স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেওয়ায় দেশের আর্থিক খাত বড় ধরনের সমস্যার মুখে পড়ছে। এতে সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনার অন্যতম উদ্দেশ্য ‘ব্যয় ও ঝুঁকি কমানো’ নীতিরও ব্যত্যয় ঘটছে। অর্থসচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি।
প্রচলিত সঞ্চয়পত্রগুলো হলো, পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্র, পাঁচ বছর মেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র এবং তিন বছর মেয়াদি ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র। এগুলোর গড় সুদের হার ১১ শতাংশের বেশি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত বছরের মে মাস থেকে বলে আসছেন, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি এবং তা কমানো উচিত। তাঁর মতে, ব্যাংকে এফডিআরের সুদের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদ বড়জোর ১ থেকে ২ শতাংশ বেশি হতে পারে। গত বছরের জুনে জাতীয় সংসদেও তিনি একই কথা বলেছিলেন। কিন্তু বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে বিরোধী দলের পাশাপাশি সরকারি দলের বিভিন্ন মন্ত্রী ও সাংসদেরা তখন এর তীব্র বিরোধিতা করেন। পরে আর সুদের হার কমানোর উদ্যোগ নেননি অর্থমন্ত্রী।
সর্বশেষ গত সোমবার ঢাকা চেম্বারের সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রাক্-বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রী আবারও বলেন, ‘ব্যাংকের আমানতের সুদের হারের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১ শতাংশ বেশি হতে পারে, কিন্তু আমাদের হার অনেক বেশি। আগে একবার কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু নানা বিষয় চিন্তা করে আর কমানো হয়নি। তবে কমানোর বিষয়টি বিবেচনায় আছে।’ পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী এবারও কমাতে পারবেন বলে মনে হয় না। দুর্ভাগ্যজনক যে এক দেশে বড় পার্থক্যের দুই ধরনের সুদের হার অনেক দিন ধরে দেখতে হচ্ছে।’