অর্থনীতি ডেস্ক :
ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আর পরিশোধ করছেন না ঋণখেলাপিরা। তাদের বিরুদ্ধে ব্যাংক মামলাও করেছে। কিন্তু বছরের পর বছর এ মামলা চলছে; নিষ্পত্তি হচ্ছে না। প্রতি বছরই পুরনো ঋণের সাথে সুদ যোগ হচ্ছে। ফলে বাড়ছে পুঞ্জীভূত মন্দ মানের ঋণের পরিমাণ। আর ব্যাংকের আয় দিয়ে এই মন্দঋণের প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। এভাবে গেল বছর ব্যাংকের আয় কমেছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকের আয় কমে যাওয়ায় অনেক ব্যাংকেরই নিট লোকসান বেড়ে গেছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বেশির ভাগ ব্যাংক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণের পরিবর্তে বড় অঙ্কের ঋণ দিতে ব্যতিব্যস্ত। বলা চলে ব্যাংকের ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে। আর এর অন্যতম কারণ হলো ভাগবাটোয়ারা। বেশির ভাগ ব্যাংকের পরিচালক ব্যবসায়ী। আবার তাদের কেউ আইনপ্রণেতাও। আইনের বেড়াজালে পড়ে নিজ ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিতে পারেন না। ফলে যোগসাজশ করে এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করায় ঋণের একটি বড় অংশই চলে যাচ্ছে ব্যাংক পরিচালকদের পকেটে। আর যেটুকু থাকছে তারও বড় একটি অংশ যাচ্ছে সুবিধাভোগীদের কাছে। ফলে ব্যাংকের ঋণ এক দিকে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে, অপর দিকে তা আদায় না হওয়ায় মন্দঋণে পরিণত হচ্ছে। মন্দঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে কমে যাচ্ছে ব্যাংকের আয়। আর আয় কমায় সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কাক্সিক্ষত মুনাফা দিতে পারছে না ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, শুধু মন্দমানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়েছে ৭ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকেরই রয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি রয়েছে জনতা ব্যাংকের ৯২৯ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের ৪৪৩ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ৩৭৪ কোটি টাকা এবং সোনালী ব্যাংকের ২৫০ কোটি টাকা। মন্দমানের খেলাপি ঋণের কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়েছে ৫ হাজার ২০৮ কোটি টাকা।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে মন্দঋণের বিপরীতে সবচেয়ে বেশি প্রভিশন সংরক্ষণ করেছে এবি ব্যাংক- প্রায় ৪৬৪ কোটি টাকা। ফলে গেল বছর ব্যাংকটির নিট আয় কমে নেমেছে মাত্র ২ কোটি টাকায়। বলা যায়, এবি ব্যাংকের এমন অবস্থা অতীতে আর কখনো হয়নি। এবি ব্যাংকের পর প্রাইম ব্যাংকের ৩৫৫ কোটি টাকা, সাউথইস্ট ব্যাংকের ৩৪২ কোটি টাকা, ইসলামী ব্যাংকের ৩২১ কোটি টাকার প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়েছে মন্দঋণের বিপরীতে।
দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বলা চলে ব্যাংক পরিচালকদের কাছে ব্যাংকের এমডিরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। কারণ, এমডিদের মাধ্যমে যা ইচ্ছে তা-ই করিয়ে নিচ্ছেন পরিচালকেরা। কিন্তু যখন দুদকে হাজিরা দিতে হচ্ছে, তখন ব্যাংকারদেরই হাজিরা দিতে হচ্ছে বেশি। তিনি আক্ষেপ করে জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনাও অতিক্রম করেছে ঋণ আমানতের পরিমাণ। কিন্তু কিছু কিছু পারিচালক চান নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তাদের বা তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ঋণ বিতরণ করা হোক। দেশের একটি বড় গ্রুপকে অতি মাত্রায় ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে, এমডি হিসেবে বাধা দিলেই চাকরি খাওয়ার হুমকি আসে। এক দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মের ব্যত্যয় ঘটার কারণে জরিমানা গুনতে ও তিরস্কার শুনতে হচ্ছে, অপর দিকে ব্যাংক পরিচালকদের চাপ। সব মিলে বেশির ভাগ এমডি আছেন মহাবিপাকে। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে সামনে ব্যাংকিং খাতের বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না বলে ওই এমডি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
দৈনিক দেশজনতা/ টি এইচ