নিজস্ব প্রতিবেদক:
২০০৯ সালে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি তদন্তে আলাদা কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ওই নির্দেশনার প্রায় দশক হতে চললেও সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি গঠন করা হয়নি। যেসব বিশ্ববিদ্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে সেগুলোরও বেশির ভাগ নিষ্ক্রিয়। কোনও কোনও কমিটি অভিযোগ পেয়েও তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে সময়ক্ষেপণ করে। কোনও কোনও কমিটি দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও অনিচ্ছা পোষণ করে বলে অভিযোগ আছে।
এমন নানা ধরনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য চেয়ে সময় বেঁধে দিয়ে গত মাসে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চিঠি দেয়। বেঁধে দেওয়া ওই সময় পেরিয়ে গেলেও তথ্য পাঠায়নি বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়।
২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট এক রায়ে যৌন হয়রানিসংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত পরিচালনা ও সুপারিশ করার জন্য প্রত্যেক সরকারি-বেসরকারি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দেন। কমপক্ষে পাঁচ সদস্যের এ কমিটির বেশির ভাগ সদস্য হতে হবে নারী। তাদের দুজন সদস্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে নিতে হবে এবং সম্ভব হলে কমিটির প্রধান হবেন নারী।
তবে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, কমিটি গঠনের উদ্দেশ্য যথাযথভাবে পূরণ হচ্ছে না। ফলে এ বিষয়ে আরও বেশি বেশি সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
ইউজিসি সূত্রে জানা যায়, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠনে হাইকোর্টের নির্দেশনার পর দেশের ৩৭ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩০টিতে এবং ৯৪টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি গঠন করেছে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটির কমিটি নিষ্ক্রিয়। কোনও কোনোটি অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করতে ও প্রতিবেদন দিতে গড়িমসি করে। এমনকি প্রতিবেদন দিলেও ব্যবস্থা নিতেও কেউ কেউ সময়ক্ষেপণ করে কোনও কোনওটি। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ নানাভাবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাও করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এমন নানা অভিযোগ রয়েছে ইউজিসির কাছে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চেয়ে গত মাসের ১১ তারিখ ইউজিসি চিঠি দেয় দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়কে। ওই চিঠির সঙ্গে তথ্যের একটি ফরম্যাট সংযুক্ত করে শূন্যস্থানগুলো পূরণ করে পাঠাতে বলা হয়। সময় দেওয়া হয় চিঠি পাঠানোর দিন থেকে ১০ কর্মদিবস পর্যন্ত। কিন্তু সেই নির্ধারিত অনেক আগেই পার হয়ে গেলেও বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসিকে তথ্য দেয়নি।
ইউজিসি সূত্র জানায়, সবশেষ রবিবার (১৫ এপ্রিল) পর্যন্ত দেশের ৩৭টি পাবলিক ও ৯৪টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পাবলিকের মাত্র ৩টি ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে মাত্র ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসিতে তথ্য পাঠিয়েছে। ইউজিসির নির্দেশ মেনে যথাসময়ে তথ্য পাঠানো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং চুয়েট (চট্টগ্রাম প্রযুক্তি ও প্রকৌশন বিশ্ববিদ্যালয়)।
অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আছে গণবিশ্ববিদ্যালয়,নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়,বিএসএমআর ইউনিভার্সিটি,ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি,কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি,বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড টেকনোলজি,নর্দান ইউনিভার্সিটি,মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি,স্ট্যামফোর্ড,বিজিসি ট্রাস্ট,সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি,সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি,বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি,রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউআইটিএস।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি’র সিনিয়র সহকারী সচিব মৌলি আজাদ বলেন,‘বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি আছে, অথচ কোনও ধরনের কার্যক্রম নেই। আবার কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে তো কমিটিই নেই। আর তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়ার পরও তারা সময়ের মধ্যে তথ্য পাঠায়নি। এতেই বোঝা যায় এতে তাদের অনীহা রয়েছে। তবে কেউ কেউ আরও সময় চেয়েছে।’ ইউজিসিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠানো তথ্য পর্যালোচনা করে জানা গেছে, বরিশাল ও চুয়েটে কমিটি গঠিত হয়েছে। কিন্তু কোনও অভিযোগ জমা পড়েনি। অন্যদিকে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযোগ জমা পড়েছে একটি। সেটির তদন্ত এখনও শেষ হয়নি।
অন্যদিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অভিযোগ জমা পড়েছিল। সেটির তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। গণবিশ্ববিদ্যালয়ে ২টি অভিযোগ জমা পড়ে। দুটিরই তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ার পর দুই শিক্ষক রাজনীতি ও প্রশাসন বিভাগের মকদুমী মুলক মাশরাফি এবং আনোয়ার হোসেন সাগরকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এছাড়া বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কমিটি থাকলেও কোনোটিতে কোনও অভিযোগ জমা পড়েনি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন হয়রানির সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে মৌলি আজাদ বলেন,‘দিনে দিনে যৌন হয়রানির প্রবণতা বাড়ছে। এখান থেকে বের হয়ে আসতে হলে এখনও অনেক সচেতনামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার প্রয়োজন রয়েছে। ইউজিসি এ বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করেছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আরও বেশি বেশি করে কাজ করতে হবে। সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।’
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি