খুলনা প্রতিনিধি:
সুন্দরবনে মাছ কমছে। এর জন্য সুন্দরবনের আশপাশে ব্যাপক শিল্পায়ন এবং জলযান চলচলের আধিক্যসহ বিভিন্ন সময়ে তেলবাহী ট্যাংকার ও কয়লাবাহী কার্গো জাহাজডুবির ঘটনাকে দায়ী করছেন পরিবেশবিদরা। এসব নিয়ে সর্বমহলে যখন উৎকণ্ঠা, তখন এরই মধ্যে রোববার (১৫ এপ্রিল) আবারও সুন্দরবনের কাছে হারবারিয়া এলাকায় কয়লাবাহী কার্গো জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে।
এর আগে সুন্দরবনের সংরক্ষিত এলাকায় ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি ১ হাজার মেট্রিক টন কয়লাবোঝাই লাইটারেজ জাহাজ এমভি আইচগাতি ডুবে যায়। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ শ্যালা নদীর ধানসাগর এলাকায় ১ হাজার ২৩৫ টন কয়লা নিয়ে ডুবে যায় কার্গো জাহাজ এমভি জাবালে নূর। ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর ৫১০ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে পশুর নদীর চিলা এলাকায় খাদ্যগুদামের (সাইলো) কাছে ডুবে যায় কার্গো জাহাজ এমভি জিয়ারাজ।
একই বছর পশুর নদীর হারবারিয়া এলাকায় সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল জিপসাম নিয়ে ডুবে গিয়েছিল এমভি সি হর্স। বড় বিপর্যয় ঘটে ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর। এ দিনে চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকারডুবির ঘটনা ঘটে। যা ধীরে ধীরে গ্রাস করে সুন্দরবনকে। উৎপাদনশীলতা ও পরিমাণের পাশাপাশি সুন্দরবন এলাকায় কমে এসেছে মাছের প্রজাতির সংখ্যাও।
মোংলার জয়মনি গ্রামের জাহাঙ্গীর হাওলাদার জানান, আগে তার কাছে জেলেরা ২০-২৫ ধরনের মাছ নিয়ে আসত। এখন পাঁচ-সাত ধরনের বেশি মাছ আসছে না। শুধু মাছ ধরার ওপর নির্ভর না করে তাই চিংড়ি ঘেরের ব্যবসায় ঝুঁকছেন এই মৎস্যজীবী। তিন দশকের বেশি সময় ধরে সুন্দরবন এলাকায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন মোংলার বেলায়েত হোসেন। চার বছর আগেও প্রতি ট্রিপে ১০ হাজার পিস মাছ ধরা পড়ত তার জালে। ২০১৪ সালে শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাংকারডুবির পর পাঁচ-সাত হাজারের বেশি মাছ পাচ্ছেন না তিনি।
মোংলার ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ী ইলিয়াস হোসেন বলেন, ৪-৫ বছর আগেও সে প্রচুর পরিমাণ মাছ মোংলা থেকে চট্টগ্রামের পরিবহন করতো। এখন সেটা কমে এসেছে। এজন্য তিনি সুন্দরবনে মাছ উৎপাদন কম হওয়াকে দায়ী করছেন। পরিবেশবিদরা বলছেন, সুন্দরবনে একর পর এক তেল ও কয়লাবাহী কার্গো জাহাজডুবির ঘটনায় ধীরে ধীরে মাছের বংশ ধ্বংস হচ্ছে। আর এর ফলে চারদিকে ধীরে ধীরে হাহাকার শুরু হয়েছে।
উদ্বেগ প্রকাশ করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী মোবাইল বলেন, ‘কয়লার ক্ষতি প্রাথমিকভাবে চোখে ধরা না পড়লেও এসব কয়লার সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন প্রভৃতি সুন্দরবনের পানি, জীব ও বায়ুমণ্ডলকে দূষিত করবে৷ আর ক্ষতিকর মিথেন গ্যাস সুন্দরবনের শ্বাসমূল উদ্ভিদ ও মাছের প্রজননের ক্ষতি করবে, যা ধীরে ধীরে মাছের বংশ করবে ধ্বংস।
মৎস্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বরে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবিরপর সুন্দরবন এলাকায় মাছের উৎপাদন লক্ষণীয় মাত্রায় কমে গেছে। অধিদফতরের তথ্য বলছে, ট্যাংকারডুবির আগের অর্থবছর (২০১৩-১৪) সুন্দরবন এলাকা থেকে মাছ আহরণ হয়েছিল ১৮ হাজার ৩৬৬ টন। ট্যাংকার ডুবির পর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৫৮০ টনে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর সুন্দরবন এলাকায় মাছের আহরণ আরো কমেছে। অর্থবছরটিতে সুন্দরবন থেকে পাওয়া গেছে মাত্র ১৬ হাজার ৮৭০ টন মাছ।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন আরো বলেন, ২০১৪ সালে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির পর ওই তেল মাছের প্রজননক্ষেত্রে ঢুকে পড়ে, যা পুরোপুরি তোলা সম্ভব হয়নি। সেই তেল মাটির সঙ্গে মিশে মাছের খাবার ও বংশবিস্তারে বাধা সৃষ্টি করেছে। পরে দেখা গেছে, ওইসব এলাকায় মাছের উৎপাদন আগের মতো হচ্ছে না। মোংলা উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা ফেরদৌস আনসারী বলেন, ‘সুন্দরবনে মাছের প্রাচুর্য বাড়ানোর জন্য জেলে, বনবিভাগ, বন্দর ব্যবহারকারীসহ সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। এছাড়া এ জায়গা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন হবে।
সেভ দ্য সুন্দরবনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, শিল্পায়ন ও জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণ না করলে মৎস্য সম্পদসহ সুন্দরবনের জন্য তা বিপর্যয় ডেকে আনবে। তাই এখনই সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিতে হবে। সুন্দরবনের সঠিক ব্যবস্থাপনায় সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান খুলনার বন সংরক্ষক মো. আমির হোসাইন চৌধুরী। তিনি বলেন, জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনা ছাড়াও জেলেদের মাছ ধরার বিষয়ে আরো সহযোগিতা করা হচ্ছে। পাশাপাশি তদারকিও আগের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে। ফলে আশা করা যায়, সুন্দরবনে মাছ আহরণ চলতি অর্থবছরে বাড়বে।
উল্লেখ্য, ১৫ এপ্রিল রোববার মোংলা বন্দর থেকে ১০ নটিকেল মাইল দূরে হারবারিয়া এলাকায় ‘এমভি বিলাস’ নামে কয়লাবাহী একটি কার্গো জাহাজ ডুবে গেছে। কার্গোটি একটি বিদেশি জাহাজ থেকে কয়লা খালাস করে চরে আটকে গেলে এ দুর্ঘটনাটি ঘটে। তবে এ ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি