নিজস্ব প্রতিবেদক:
জাটকা রক্ষা ও ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে চাঁদপুরসহ দেশের পাঁচটি অভয়াশ্রম এলাকায় ইলিশ আহরণ, পরিবহন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে মৎস্য অধিদফতর। তবুও বৈশাখকে ঘিরে বাজারে আসছে প্রচুর পরিমাণ ইলিশ। দামও আকাশচুম্বী। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পহেলা বৈশাখকে ঘিরে রমরমা বাণিজ্য হয় ইলিশের। তাই নদী থেকে অবাধে ধরা হচ্ছে ইলিশ, পাশাপাশি হিমাগারে সংরক্ষণ করা ইলিশও বাজারে আসছে।
এ বিষয়ে মৎস্য অধিদফতরের জাটকা সংরক্ষণ ও গবেষণা প্রকল্পের পরিচালক এবিএম জাহিদ হাবিব বলেন, মার্চ ও এপ্রিল দেশের বিভিন্ন অভয়াশ্রমে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ। তবে ওই এলাকার বাইরে ইলিশ ধরা যাবে। মূলত সেসব এলাকা থেকেই বাজারে ইলিশ আসছে। কিন্তু জাটকার ক্ষেত্রে বিষয়টি অবৈধ। কারণ সব স্থানেই এ সময় জাটকা আহরণ নিষিদ্ধ।
সরেজমিন রাজধানীর পুরান ঢাকার নয়াবাজার, শান্তিনগর কাঁচাবাজার, মালিবাগ বাজার ও কারওয়ান বাজার ঘুরে ইলিশের পর্যাপ্ত সরবরাহ দেখা গেছে। বড় আকারের ইলিশের সঙ্গে মাঝারি, ছোট ও জাটকা মাছ বিক্রি করতে দেখা গেছে এসব বাজারে। মাছ বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যবসায়ীরা হিমাগারে সংরক্ষণ করা ইলিশ বিক্রি করছেন। পাশাপাশি নদী থেকে ধরা ইলিশও আসছে প্রচুর, যা বাজারে তাজা মাছ হিসেবে আরও চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারে ইলিশ বিক্রেতা রবিউল ইসলাম বলেন, ইলিশের বাজারে বৈশাখের উন্মাদনা চলছে। অনেকেই ইলিশ কিনতে শুরু করেছেন। তাই দাম একটু বেশি। তবে বড় ইলিশের তুলনায় ছোট ও মাঝারি ইলিশের চাহিদা বেশি দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, মঙ্গলবার বড় আকারের এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয় ১৮শ’ থেকে ২ হাজার টাকায়। তবে দুই সপ্তাহ ধরে এই আকৃতির ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১৩শ’ থেকে ১৪শ’ টাকায়। ৮০০ গ্রাম ওজনের এক পিস বিক্রি হয় এক হাজার টাকায়, গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছিল ৮০০ টাকায়। ৭০০ গ্রাম ওজনের এক পিস ইলিশ বিক্রি হয় ৭০০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৬০০ টাকায়। ৫০০ গ্রাম ওজনের এক পিস ইলিশ বিক্রি হয় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া নিষেধাজ্ঞা থাকলেও জাটকাও বিক্রি হচ্ছে অবাধে, যা কেজিপ্রতি ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়।
এদিকে মঙ্গলবার ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবির দৈনিক বাজার মূল্যতালিকায় সপ্তাহের ব্যবধানে ইলিশের দাম বাড়তে দেখা গেছে। সেখানে মঙ্গলবার এক কেজি ইলিশের দাম দেয়া আছে ৭০০ থেকে ১৮শ’ টাকা, যা গত সপ্তাহে দাম ছিল ৫০০ থেকে ৯০০ টাকা। আর এক মাস আগে এর দাম দেয়া আছে ৪০০ থেকে ৯০০ টাকা। সেক্ষেত্রে মাসের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৯২ দশমিক ৩১ শতাংশ।
কারওয়ান বাজারের আড়তদার খালেদ মিয়া জানান, অভয়াশ্রমের বাইরে ইলিশ শিকার চলছে। পাশাপাশি নিষিদ্ধ এলাকায়ও অবৈধভাবে জাল ফেলছেন জেলেরা। সেসব ইলিশই সরাসরি জেলেদের কাছ থেকে কিনে স্থানীয় ও শহরের বাজারে তুলছেন কিছু ব্যবসায়ী। ক্যাবের সভাপতি ড. গোলাম রহমান বলেন, বৈশাখে ইলিশের চাহিদা বেশি থাকায় বাড়তি আয়ের লক্ষ্যে অনেক জেলে অবৈধভাবে ইলিশ শিকার করছেন। তিনি আরও বলেন, পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খেতে হবে, এটা কোনো গ্রন্থে লেখা নেই। তবুও সাধারণ ভোক্তারা বিলাসিতার কারণে এই পান্তা-ইলিশ খেয়ে থাকেন, যা কখনোই কাম্য নয়।
বরিশাল ব্যুরো জানায়, পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে প্রতিদিন শত শত টন মিয়ানমারের ইলিশ ঢুকছে বাংলাদেশে। একই সঙ্গে হিমাগার আর মৎস্য ব্যবসায়ীদের ফ্রিজে থাকা হাজার হাজার মণ ইলিশ আসছে বাজারে। তারপরও দাম খুব একটা কমছে না। পান্তা-ইলিশের নেশায় বিভোর বাঙালির চাহিদার সঙ্গে তালমিলিয়ে দামের পারদটা রয়ে যাচ্ছে একই জায়গায়। ফলে বুধবারও বরিশালের ইলিশ মোকামে কেজি সাইজের প্রতি মণ ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকায়। কয়েক হাত ঘুরে খুচরা বাজারে যাওয়ার পর প্রতি কেজি সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায় এই ইলিশ কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। কেজি সাইজের নিচের ইলিশ খানিকটা কম দামে বিক্রি হলেও মূল্যহার প্রশ্নে তার দামও প্রতি কেজি ২ থেকে আড়াই হাজারের নিচে নামছে না। সব মিলিয়ে আগামী কয়েক দিনে ইলিশের দাম যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটাই এখন দুশ্চিন্তা নববর্ষ বরণের অপেক্ষায় থাকা বাঙালির।
গেল সপ্তাহে বরিশালের পোর্ট রোডের ইলিশ মোকামে কেজি সাইজের ইলিশ মণপ্রতি বিক্রি হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায়। তখন পর্যন্ত মজুদদারদের হিমাগার এবং ছোট ছোট মাছ ব্যবসায়ীর আড়ত আর বাসাবাড়ির ফ্রিজে জমাট বাঁধা অবস্থায় ছিল হাজার হাজার মণ ইলিশ। একদিকে ইলিশের খারাপ মৌসুম, অন্যদিকে ৮ মাসব্যাপী জাটকা নিধনবিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকায় ইলিশের আমদানিও খুব একটা ছিল না। তাই দিনকে দিন বাড়ছিল ইলিশের দাম। এমন অবস্থায় বৃহস্পতিবার থেকে দেশে ঢুকতে শুরু করেছে মিয়ানমারের ইলিশ। খেতে বিস্বাদ হলেও চোখের দেখায় হুবহু বাংলাদেশের ইলিশের মতো এবং দাম খানিকটা কম। তাই এই ইলিশের প্রতি হুমড়ি খেয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। বরিশাল মৎস্য আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক নীরব হোসেন টুটুল জানান, ‘বৈধ পথেই মিয়ানমার থেকে ইলিশ আসছে। মিয়ানমার থেকে প্রথমে ঢাকায় এবং পরে তা বরিশালসহ সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।’
বরিশাল ইলিশ মোকামের ব্যবসায়ী, সিকদার ফিশ ট্রেডিংয়ের মালিক জহির সিকদার অবশ্য জানান, ‘কমতে শুরু করেছে ইলিশের দাম।’ অবশ্য সিকদারের বক্তব্যের খুব একটা সত্যতা মেলেনি বরিশালের ইলিশ মোকামে। বর্তমানে যা পরিস্থিতি, তাতে পহেলা বৈশাখের আগে ইলিশের দাম আরও বাড়বে বলে আভাস দিয়েছেন মোকামের পাইকাররা।’
ইলিশের বাড়ি চাঁদপুরে এবার মজুদ ইলিশেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন করবেন ভোক্তারা। জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে জেলার একমাত্র বেসরকারি কোল্ড স্টোর খন্দকার ফিশ প্রসেসিং কর্তৃপক্ষ মাত্র ১২০ টন ইলিশ মজুদ করেছে। জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষায় দেশের পাঁচটি অভয়াশ্রমে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চলছে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি। ফলে মাছ ক্রেতা ও বিক্রেতাদের মধ্যেও এর প্রভাব দেখা গেছে।
সরেজমিন চাঁদপুরের ইলিশের মাছঘাট খ্যাত বড়স্টেশন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, ইলিশ নেই। তাই মাছের আড়তদাররা শরীয়তপুরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আসা রুই-কাতলাসহ বিভিন্ন মাছ নিয়ে কিছুটা সময় কাটাচ্ছে। আবার কেউ কেউ নিষেধাজ্ঞা কেটে যাওয়ার আগেই নিজেদের আড়ত ও আশপাশের এলাকা অবকাঠামো নতুন করে মেরামত করছেন।
চাঁদপুর মৎস্য-বণিক সমবায় সমিতির সভাপতি আ. খালেক মাল বলেন, ২ মাসের নিষাধাজ্ঞার কারণে বস্তুত বেকার এখানকার ব্যবসায়ীরা। বৈশাখে মজুদ ইলিশের ওপরই আমাদের ভরসা করতে হবে। তিনি জানান, অন্যবারের তুলনায় এবার ইলিশের চাহিদা কম।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি