নিজস্ব প্রতিবেদক:
রোগ নির্ণয়ের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যে সকল ডায়গনস্টিক রিপোর্ট প্রণয়ন করা হয়, তার মোট মূল্যের ৪০ ভাগ কমিশন সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপত্র প্রদানকারী চিকিৎসক পেয়ে থাকেন। কমিশনের পাশাপাশি সুপারিশ করায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কাছ থেকে নানা ধরনের উপহার সমগ্রী পেয়ে থাকে তারা। ফলে কমিশন ও উপহার সমগ্রী গ্রহণের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের মালিক হচ্ছেন চিকিৎসকরা।
দুদক বিষয়টিকে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে চিকিৎসকদের এই দুর্নীতিরোধে প্যাথোলজিক্যাল ডায়গনস্টিক সেন্টারসমূহে প্রতিটি পরীক্ষার সর্বোচ্চ ও সর্বনিন্ম মূল্য সরকারিভাবে নির্ধারণ করার পরামর্শ দিয়েছে।
এছাড়াও স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ উঠে এসেছে দুদকের প্রতিবেদনে।
স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি সম্পর্কে দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের অধিকাংশ চিকিৎসক নিরালসভাবে চিকিৎসা সেবা প্রদান করলেও কতিপয় চিকিৎসকের দায়িত্ব অবহেলা, অনুপার্জিত আয়ের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের আকাঙ্ক্ষাসহ অনৈতিক কমর্মকাণ্ডের কারণে মানসম্মত চিকিৎসা অন্যতম অন্তরয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
পাশাপাশি চিকিৎসা সমগ্রী ক্রয়, মেরামত, অবকাঠামো নির্মাণ, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, বদলি, পদায়ন দুর্নীতির উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
দুর্নীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, কতিপয় সরকারি চিকিৎসক অফিস কর্মকালে কর্মক্ষেত্রে না যেয়ে প্রইভেটে প্রাকটিস করছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রায় ৬০ শতাংশ চিকিৎসক কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন।
এ সমস্য নিরসনে দুদকের সুপারিশে বলা হয়েছে, চিকিৎসকদের নিয়মিত কর্মস্থলে উপস্থিত নিশ্চিত করার জন্য বায়োমেট্রিক হাজিরা গ্রহণের ব্যবস্থা ও মনিটারিং করা।
প্রতিবেদনে দুর্নীতির অন্যতম উৎসে বলা হয়েছে, চিকিৎসকরা বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে কমিশন ও উপহার গ্রহণ করার ফলে নির্দিষ্ট কোম্পানির ওষুধের নাম লিখছেন। এর মাধ্যমে চিকিৎসকরা অবৈধ সম্পদের মালিক হচ্ছেন।
এই জন্য চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের ব্রান্ড নাম না লিখে জেনেরিক নাম লেখা বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করা হয়েছে দুদকের প্রতিবেদনে।
স্বাস্থ্যখাতের সুপারিশে বলা হয়েছে, ইন্টার্নশিপ ১ বছর থেকে বাড়িয়ে দুই বছর করা এবং বর্ধিত এক বছর উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে থাকা বাধ্যতামূলক করা, তাহলে উপজেলা পর্যায়ে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে কাজ না করলে উচ্চ শিক্ষার অনুমতি না দেওয়া।
এছাড়া সুপারিশে আরো বলা হয়েছে—
চিকিৎসকদের জন্য যুগোপযোগী ক্যারিয়ার প্লানিং এবং বদলি নীতিমালা প্রণয়ন করা সমীচীন। এছাড়া চিকিৎসকদের পদোন্নতি বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের পরীক্ষার মাধ্যমে সম্পন্ন করা যেতে পারে।
প্রতিবেদনে চিকিৎসা সমগ্রী ক্রয়, সরবরাহ ও মেরামত খাত দুর্নীতি উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, হাসপাতালের চিকিৎসা সমগ্রী যেমন ওষুধ, যন্ত্রপাতি ক্রয়ে কথিত দুর্নীতির অভিযোগ দুদকের কাছে আসে।
সুপারিশে বলা হয়েছে, সকল ক্রয় ই-জিপির আওতায় করা সম্পন্ন করা। স্বাস্থ্যখাতের সকল ক্রয় কমিটিতে সংশ্লিষ্ট খাতে অভিজ্ঞ চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং ক্রয় কাজে দক্ষ কর্মকর্তার অন্তর্ভুক্তির পরামর্শ দেওয়া হয়। এছাড়া যে সকল সরকারি হাসপতালগুলোতে Medical Equipment পরিচালনার জন্য দক্ষ জনবল নেই, সে সকল হাসপাতালে মূল্যবান যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে তা অব্যবহৃত রেখে সম্পদ নষ্ট করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমতি যন্ত্রপাতি সরবরাহ জরা সমীচীন নয়।
দুদকের প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি আরো একটি উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগকে। সেখানে বলা হয়েছে, হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি এবং পদায়নের ক্ষেত্রে কথিত অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যায়। এমনকি এজাতীয় অপরাধে দুদকে একাধিক মামলাও রয়েছে।
এই দুর্নীতিরোধে সুপারিশে বলা হয়েছে, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ প্রদানের জন্য প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের মনিটারিং ব্যবস্থা গ্রহণ এবং হাসপাতালসমুহের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে প্রতি তিন বছর পর পর বদলির ব্যবস্থা করা।
দুদকের সুপারিশের ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন বিভাগের পরিচালক অাশীষ কুমার সাহা পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, দুদকের সুপারিশ সবগুলো যুক্তিযুক্ত। এটা আমার মনেরও কথা। যদিও তাদের সুপারিশগুলো এখানে এসে পৌঁছায়নি। আসলে তাদের সুপারিশগুলো চিন্তা-ভাবনা করবো আমরা।
তিনি বলেন, ডাক্তার মনিটারিং থাকাটা জরুরি, এর মাধ্যমে আমাদের চিকিৎসায় মানুষের আস্থা ফিরবে।
তিনি বলেন, দেশের প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো মূল্য নির্ধারণ থাকাটা জরুরি। কেননা সেখানে অতিরিক্ত মূল্য রাখা, কাজেই তাদেরকে বিধির ভিতরে নিয়ে আসাটা জরুরি।
এসময় তিনি বলেন, দেশের কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত জনগোষ্ঠীকে সেবা দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে যদি ইন্টার্ন চিকিৎসকদের এক বছর উপজেলা পর্যায়ে রাখা যায়, সেটা খুবই ভালো হবে।
এব্যাপারে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের অসঙ্গতিগুলো তুলা ধরা এবং সমস্যা নিরসনে সুপারিশ করা। বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ