নিজস্ব প্রতিবেদক:
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সব পাবলিক পরীক্ষাসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায়ও টানা প্রশ্নপত্র ফাঁস হতে দেখা গেছে। সর্বশেষ গত এসএসসি পরীক্ষায় প্রায় সব বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। এরপর এইচএসসি পরীক্ষা সামনে রেখে কঠোর অব্স্থান নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর প্রতিফলন দেখা গেছে এরই মধ্যে শেষ হওয়া এইচএসসি ও সমমানের দুটি বিষয়ের। গত সোমবার (২ এপ্রিল) থেকে শুরু হওয়া এ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনও অভিযোগ এখনও পাওয়া যায়নি। এতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সাধুবাদ জানিয়ে প্রশ্নফাঁস না হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদরা। তবে পরীক্ষা পদ্ধতির স্থায়ী পরিবর্তনসহ বেশ কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন তারা।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুয়েটের কম্পিউটার কৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত খুশি বহুদিন পর প্রশ্নফাঁসমুক্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দুটি পরীক্ষা হয়েছে তাতে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি—এতে খুবই আনন্দিত আমি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেক সজাগ হয়েছে। প্রশ্নফাঁস যেন না হয়, সেজন্য তাদের অবস্থান আসলেই চোখে পড়ার মতো, আমরা মুগ্ধ হয়েছি।’ তবে তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় বিষয় যেটি, সেটি হচ্ছে—পরীক্ষার এই বিদ্যামান পদ্ধতি অবশ্যই পরিবর্তন করা দরকার। কারণ, এই পদ্ধতি বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ফলে আমি চাই একটি স্থায়ী ও টেকনিক্যাল পদ্ধতি আসুক, যাতে প্রশ্নফাঁসের কোনও আশঙ্কা না থাকে।’
মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘আমরা একটি কমিটি প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধে করণীয় স্থায়ী সমাধান নিয়ে কাজ করছি। কাজ শেষ হলেই আমরা সুপারিশ দেবো।’
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘এবার পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস হচ্ছে না—এটা খুবই একটি ভালো খবর। ধারাবাহিকভাবে যেভাবে প্রশ্নফাঁস হচ্ছিল তার ধারা যদি এবারও থাকতো তাহলে সংশ্লিষ্টদের পদত্যাগ করা ছাড়া কোনও উপায় থাকতো না। তাছাড়া প্রশ্নফাঁস নিয়ে সরকারের সম্মান একদমই তলানিতে চলে গিয়েছে। তারপরও শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে আগের তুলনায় অনেক নতুন নতুন স্টেপ নিয়েছে, এ জন্য তাদের সাধুবাদ জানাই। কিন্তু এসব স্টেপ আগেই নিতে পারতো, কিন্তু তা তারা করেনি। এতে প্রমাণিত হয়—তাদের দুর্বলতা রয়েছে।’ তারপরও পরীক্ষা পদ্ধতি বাধ্যতামূলকভাবেই পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি বেশ কয়েকটি সুপারিশ দেবো। আগেও বলেছি, এখনও বলছি—পিইসি, জেএসসি পরীক্ষা তুলে দিতে হবে। পাবলিক পরীক্ষা বলতে শুধু এসএসসি ও এইচএসসি থাকা উচিত। এই জেএসসি-পিইসি তুলে দিলে প্রশ্নফাঁসসহ নানা ধরনের সমস্যা চলে যাবে। এছাড়া কোনও পাবলিক পরীক্ষাতেই এমসিকিউ রাখা যাবে না। প্রশ্ন হবে সৃজনশীল। আর সৃজনশীল প্রশ্ন হলে পরীক্ষার্থীকে কষ্ট করে লিখে তারপর মার্কস পেতে হবে, যা এমসিকিউর বেলায় ঘটে না। এছাড়া দেশের ১০ শিক্ষা বোর্ড ভেঙে সারাদেশের জেলা পর্যায়, উপজেলা পর্যায়ে বোর্ড বসাতে হবে। ওই বোর্ডের কর্মকর্তারাই ছোট ছোট পরিসরে পরীক্ষা নেবেন, এতে করে পরীক্ষা নেওয়াও অনেক সহজ হয়ে আসবে।’
অন্য আরেকটি সুপারিশও তিনি তুলে ধরেন, “অন্য একটি পদ্ধতির কথা বলবো, তা হলো ‘ওপেন বুক এক্সাম’। এই পদ্ধতিটা অনেক দেশেই আছে। ক্লাসে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেবে, সেখান থেকে কিছু মার্কস যোগ হবে ফাইনাল পরীক্ষায়। সেভাবেই চূড়ান্ত ফলাফল প্রণয়ন হবে।” এসব পদক্ষেপ ঠিকঠাক করতে পারলে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
নটরডেম কলেজের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ এ এন রাশেদা বলেন, ‘প্রশ্নপত্র এবার ফাঁস হচ্ছে না—এটা আমরা জেনে খুশি হয়েছি। কিন্তু এখন যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, আগের পরীক্ষাগুলোর সময় কেন নেওয়া হয়নি? মন্ত্রণালয় তো স্বীকারই করে না প্রশ্নফাঁস হয়েছে! সবশেষ এসএসসি পরীক্ষায় টানা প্রশ্নফাঁস হলো তখনও তো স্বীকার করেনি, পরীক্ষা বাতিল করে নতুন পরীক্ষার আয়োজনও করেনি। একদিকে প্রশ্নফাঁস হয়েছে, অন্যদিকে পরীক্ষা নিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এখন যেসব নতুন নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তা আগেও নিতে পারতো। কিন্তু তারা নেয়নি, কারণ প্রশ্নফাঁসকে তারা অবহেলা করে। তবে বিদ্যমান পদ্ধতির অব্যশই পরিবর্তন করতে হবে। প্রশ্নফাঁস এবার হয়নি বলে যে আর হবে না, তা তো শতভাগ বলতে পারেনি মন্ত্রণালয়। তাহলে বুঝতে হবে, এই পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন দরকার।’
কী ধরনের পরিবর্তন দরকার বলে মনে করেন জানতে চাইলে এ এন রাশেদা বলেন, ‘আমি তো বলবো, এমন শোরগোল ফেলে দিয়ে পাবলিক পরীক্ষার আয়োজন করারই দরকার নেই। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা বছর যেভাবে পরীক্ষা নেওয়া হয়, সেই পরীক্ষা থেকেই যেমন রেজাল্ট সমষ্টি করে ফাইনাল রেজাল্ট তৈরি করা হয়, পিইসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা বাদ দিয়ে এমন ব্যবস্থা করলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এত প্রশ্নফাঁসের ঝুঁকিতেও থাকা লাগবে না, শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ওপরও এত টর্চার হবে না। ক্লাসেই পড়বে শিক্ষার্থীরা, ক্লাসেই পরীক্ষা দেবে, সেখান থেকেই রেজাল্ট হয়ে যাবে। এতে শিক্ষার্থীরা আরও অনেক ভালোভাবে পড়বে, শিক্ষকরাও পড়াবেন। আমি মনে করি এই ব্যবস্থা সবচেয়ে কার্যকর হবে।’
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি