মারুফ শরীফ, নিজস্ব প্রতিবেদক :
সন্দেহজনক ব্যাংকিং লেনদেনের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করায় দুদকের প্রতি ‘চ্যালেঞ্জ’ ছুড়ে দিয়েছেন অভিযুক্ত বিএনপি নেতারা। গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে বিএনপির ৮ সিনিয়র নেতাসহ ৯ জনের ব্যাংক একাউন্ট থেকে অস্বাভাবিক লেনদেনের যে তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রকাশ করেছে তা বানোয়াট, ভিত্তিহীন, মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্যেশ্য প্রণোদিত বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির অভিযুক্ত এসকল সিনিয়র নেতারা। দুধকের এ অভিযোগ এবং এর ভিত্তিতে চালানো তদন্ত বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করার এক হীন প্রচেষ্টা বলেও মন্তব্য করেন নেতারা।
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ব্যাংকের মাধ্যমে সন্দেহজনক অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগ তুলে দুদক যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে তারা হলেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির চারজন সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা আব্বাস ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, দুইজন ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ও এম. মোর্শেদ খান, যুগ্ম মহাসচিব এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল, আবদুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে তাবিথ আওয়াল এবং এম. মোর্শেদ খানের ছেলে ফয়সাল মোর্শেদ খান।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত জরুরী সংবাদ সম্মেলনে আত্মপক্ষ সমর্থন বক্তব্য রাখেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু। দলের স্থায়ী কমিটির অভিযুক্ত আরেক সদস্য মির্জা আব্বাসের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
সংবাদ সম্মেলনে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, দুদকের বক্তব্যে আমার নাম জড়ানো হয়েছে। একদিকে আমাদের দলের নেত্রীকে একটি মিথ্যা মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে এবং তাঁর জামিন বিলম্বিত করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। অন্যদিকে দলের মহাসচিব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। এমন সময় দুদক একটি বানোয়াট, মিথ্যা কল্পকাহিনী প্রচার করছে। দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে তারা হীন প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা এসবের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
দুদকের এই অনুসন্ধান সম্পর্কে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, গত ১৭ মার্চ ‘বাংলা ইনসাইডার’ পোর্টালে গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে রিপোর্ট করে ১২টি চেকের মাধ্যমে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টে আমি ২১ কোটি টাকা লেনদেন করেছি। দুদক যে রিপোর্ট দিয়েছে, সেখানেও একই বলা হয়েছে।
ড. মোশাররফ ২১ কোটি টাকা লেনদেনের যে তথ্য দেয়া হয়েছে তার উপর ‘চ্যালেঞ্জ’ করে তিনি বলেন, ডাচ বাংলা ব্যাংকে আমার এবং আমার পরিবারের কারো কোনো একাউন্টই নাই। দুদক যে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে আমি দুদককে অনুরোধ করবো কোন একাউন্টে, কোন ব্রাঞ্চে, কবে কখন কত টাকা উত্তোলন হয়েছে। এমনকি কত টাকা স্থিতি আছে তা বিস্তারিত প্রকাশ করা হোক।
ড. মোশাররফ বলেন, এর আগেও সরকার দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ আমাকে জড়িয়ে নানা কল্পিত সম্পদের মিথ্যা তথ্য প্রচার করেছিল। তখন আমার নামে বলা হয়েছিল সিঙ্গাপুরে নাকি আমি ৫ তারকা হোটেলের শেয়ার হোল্ডার। প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টেও এগুলো নিয়ে কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, এখন অনলাইনের মাধ্যমে বিশ্বের যে কোন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোল্ডারদের তথ্য পাওয়া যায়। তারা তখন এর কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি। এদিকে ‘বাংলা ইনসাইডার’ নামের একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে বলা হয়েছে গোয়েন্দা রিপোর্টের তথ্যমতে ১৭ মার্চ তারা রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে। যে নিউজের কোনো নির্ভর যোগ্যতা নেই।
ড. মোশাররফ বলেন, গতকাল দুদক থেকে গণমাধ্যমকে একই ধরনের একটা হ্যান্ডনোট পাঠিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে বিএনপির ৮ জন সিনিয়র নেতাসহ ৯ জনের ব্যাংক একাউন্টে সন্দেহজনক অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে।
‘বাংলা ইনসাইডার’ নামক পোর্টালটি কারা চালায়, এর মালিক কে, জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা কতটুকু এমন প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, তারা ১৭ মার্চ এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। বলা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের ভিত্তিতে হয়েছে এ রিপোর্ট। আমরা জানতে চাই, কেন দুদককে আগে তথ্য না দিয়ে গোয়েন্দারা ওই ‘বাংলা ইনসাইডার’কে কেন তথ্য দিবে? ‘বাংলা ইনসাইডার’ পোর্টালটি কী তাহলে দুদকের কাউন্টার পার্ট? ‘বাংলা ইনসাইডার’ মিথ্যা বানোয়াট তথ্যভিত্তিক রিপোর্ট দিয়ে দুদক ও প্রধানমন্ত্রীকে মিসগাইড করেছে।
তিনি বলেছেন, দুদকও গতকাল বলেছে গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে আবার বাংলা ইনসাইডারেও একই তথ্য লেখা হয়েছিল।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, যখন দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন বেগবান হচ্ছে তখন তারা এসব মিথ্যা বানোয়াট তথ্য উপস্থাপন করে জনগনকে বিভ্রান্ত করতে এবং তাদের দৃষ্টিকে ব্যাংক লুট, শেয়ার বাজার লুট ও আওয়ামী লীগ সারা বিশ্বে ‘স্বৈরাচারী সরকার’ হিসেবে ভুষিত হচ্ছে তখন জনগনের দৃষ্টি অন্য দিকে সরাতে এগুলো করছে সরকার।
বিএনপির জতীয় স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমার নামে ৭ কোটি টাকার তথ্য দিয়েছে বাংলা ইনসাইডার ও দুদক। এটা একটা নোংরা রশিকতা। আমার ব্যাপারে বলা হয়েছে সোহেলের (হাবীব উন-নবী-খান সোহেল) সঙ্গে যৌথভাবে আমি ৭ কোটি টাকা লেনদেন করেছি। ৭ কোটিতো দূরের কথা ৭ লাখ টাকা লেনদেন করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি সারাজীবনেও ৭ কোটি টাকা লেনদেন করতে পারিনি।
সুতরাং, যে পোর্টাল এ ধরনের মিথ্যা, বানোয়াট নিউজ করে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের আইনি ব্যবস্থা নেয়া উচিত, যেমনটি আমরা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নিয়েছিলাম। নোংরা রসিকতার একটা সীমা থাকা দরকার। কারো সম্মানহানি করার আগে একশবার ভাবা উচিত বলেন নজরুল ইসলাম খান।
সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, বড় বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, এদের থামান। এগুলো করে আমাদের কিছু করতে পারবেন না। আমরা আন্দোলন করি দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে আটক করে আমাদের আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না, আমদের ঐক্য নষ্ট করা যাবে না।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, বাংলা ইনসাইডার কাদের প্রতিষ্ঠান তা আমরা বুঝি না। তারা কি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিষ্ঠান যে, তারা দুদকের আগে রিপোর্ট পায়। নাকি সরকারের কোনো সংস্থা, যে সরকারের নির্দেশে গোয়েন্দারা তাদের রিপোর্ট দেয়। সরকারের উদ্যেশ্যে বলতে চায়, বাংলা ইনসাইডারের নামে মিথ্যা গল্পকাহিনী বানানোর কারখানা হিসেবে ব্যবহার করে এবং দুদককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের ঐক্যকে বিনষ্ট করা যাবে না। একই সঙ্গে বাংলা ইনসাইডারকে মিথ্যা বানোয়াট তথ্য প্রকাশের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তিনি হুঁশিয়ারী করেন।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সরকার সমস্ত ব্যাংকগুলো লুট করে জনগনের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে মিথ্যাচার করে তা প্রচার করছে। আওয়ামী লীগ বাংলা ইনসাইডারের মতো ২৫ টি পোর্টাল করেছে। বিএনপির বিরুদ্ধে ফেক নিউজ প্রচার করার জন্য।
আমীর খসরু বলেন, সামনে আরো মিথ্যাচার দেখতে পাবেন। কষ্ট হচ্ছে এজন্য যে, দুদকের মতো স্বাধীন প্রতিষ্ঠানকেও ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। তারা এই কাজটি করছে কেবল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। একটি দেশ তখনই ধ্বংস হয়, যখন সে দেশের স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়। মূলত, বাংলাদেশকে ধ্বংস করার জন্যই রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হচ্ছে। এর পরিণতি ভালো হবে না বলেন আমীর খসরু।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, আমি ব্যবসা করি। আমাকে প্রচুর লেনদেন করতে হয়। আমার বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে তারা তদন্ত করতে পারে। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট বা বাংলা ইনসাইডারের রিপোর্টের ভিত্তিতে হয়রানি কেন করতে হবে?
মিন্টু বলেন, আমাদের কয়েকজন নেতাকে আটক করে কোনো লাভ হবে না। জেলে যাওয়ার জন্য আমরা সব সময় প্রস্তুত থাকি। সঙ্গে একটি ব্যাগে কাপড়-চোপড়ও রাখি। বিএনপির কর্মীরাই আন্দোলনের মাধ্যমে সমুচিত জবাব দেয়ার জন্য যথেষ্ঠ। সুতরাং, আমাদেরকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, উপদেষ্টা আব্দুস সালাম, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ, নির্বাহী সদস্য আমিনুল ইসলারূ প্রমুখ।
দৈনিক দেশজনতা /এন আর