নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরি ও শৃঙ্খলা বিধিমালার গেজেট জারি করতে মাসদার হোসেন মামলার শুনানিতে আবার রাষ্ট্রপক্ষের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছেন, ‘আপনারা বিচার বিভাগকে বিক্ষুব্ধ করবেন না।’
সোমবার আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে মামলাটির শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরি ও শৃঙ্খলা বিধিমালার গেজেট প্রকাশ করতে অ্যাটর্নি জেনারেল আবারও সময় আবেদন করেন। পরে শুনানি শেষে সরকারকে আরো দুই সপ্তাহের সময় দেয় আপিল বিভাগ।
তবে অ্যাটর্নি জেনারেল সময়ের আবেদন করার পরই বিচারকদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় তাকে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কারণটা কী?’।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘প্রসেস চলছে।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা হাসবো না কাঁদবো? হাসার জন্যতো মনের একটা কষ্ট হয়। অ্যানিওয়ে, আমি কিছু বলছি না। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হয়ে গেছে, কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে, কিছু অনিয়ম আছে। এগুলো নিয়ে সারাজীবন নয়, আমরা চাচ্ছি একটা সিস্টেমে চলে আসতে। প্রধান বিচারপতি অনিয়ম থেকে নিয়মে আসতে গেলেই বলে গেলো গেলো।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘পত্রিকায় বলা হয়, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব। আপনার মিনিস্ট্রিকে বলবেন, জেনারেল ক্লজ অ্যক্টের ২১ পড়তে।’
বিচার বিভাগের যেসব কর্মকর্তা প্রেষণে সরকারের অন্য বিভাগে কাজ করছেন সেই বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, ‘সরকারকে বলবেন, যেসব বিচারক প্রেষণে আছে তারা সরকারি কর্মচারী না। আমরা, সুপ্রিম কোর্টের কর্মচারীরা কে কোথায় যায় কি করে সব দেখি। তেমন তাদের (প্রেষণে থাকা কর্মকর্তা) ক্ষেত্রেও। সুপ্রিম কোর্ট জানতে চেয়েছিলো প্রেষণে কারা বিদেশে যায় তাদের নাম।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘যত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ডেপুটেশনে দিয়েছি, যদি তাদের প্রত্যাহার করি তাহলে কারো কিছু করার নেই। বিচারকদের ডেপুটেশনে দিয়ে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে কাজ করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। ১৮৯৭ সালের সেকশন ২১ দেখেন। যদি না হয় এটা ডিলিট করে দেন। এটা এতো দিন ধরে চলে আসছে।’
শুনানির এক পর্যায়ে সিনহা বলেন, ‘আপনারা বিচার বিভাগকে বিক্ষুব্ধ করবেন না, রাষ্ট্রপতির অনুশাসন বলে এমন কিছু করতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতির কাছে কোনো ফাইল পাঠিয়ে যদি বলা হয় করবেন, তখন তিনি হ্যাঁ বলেন, না বললে না বলেন। তাই বলছি, ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। ভুল বুঝাবুঝি যত কম হয় ততই ভাল।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘তারা মনে করলে সুপ্রিম কোর্টের ওপর আদেশ করবে। এটা ভুল করবে। রাষ্ট্র এ রকম করতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টের প্রত্যকটা সিদ্ধান্ত সিনিয়র বিচারকগণ চিন্তা করে নেয়। তারা যদি মনে করে যে, আইনের একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে দেবে তাহলে খুব ভুল করবে।’
অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলা হয়, ‘আপনারা যদি আইন না জানেন, তাহলে আমাদের কাছে ব্যাখ্যা চাইবেন। বিডিআরের মামলা কোন আইনে চলবে সেটা আমাদের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে, আমরা বলে দিয়েছি। সংবিধান অনুসারে ব্যাখ্যা আমরা দিব, নির্বাহী নয়। এগুলো মনে করে চলবেন।’
মাহবুবে আলমকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মিস্টার অ্যাটর্নি জেনারেল, আপনি তো বুঝতেছেন, আপনার হাসি হয় না। আপনার হাসিটা আমরাও বুঝি। এটা বিচার বিভাগের জন্য মঙ্গলজনক নয়। অল্প বিদ্যা ভয়ংকর। মারাত্মক হয়ে যাবে। তারা যদি (আইনমন্ত্রণালয়) আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে বলে এটাই কারেক্ট, খুব ভুল হয়ে যাবে ‘
১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেন মামলায় ১২দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয়া হয়। ওই রায়ের আলোকে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল। আপিল বিভাগের নির্দেশনার পর গত বছরের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় একটি খসড়া শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধি প্রস্তুত করে সুপ্রিমকোর্টে পাঠায়।
গত বছরের ২৮ আগষ্ট এই মামলার শুনানিতে আপিল বিভাগ জানান, শৃঙ্খলা বিধিমালা সংক্রান্ত সরকারের খসড়াটি ছিল ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার হুবহু অনুরূপ। যা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থী। এরপরই সুপ্রিম কোর্ট একটি খসড়া বিধিমালা করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। একইসঙ্গে ওই বছরের ৬ নভেম্বরের মধ্যে তা প্রণয়ন করে প্রতিবেদন আকারে আদালতকে অবহিত করতে আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়।
দৈনিক দেশজনতা/ এমএইচ